১৬ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ৯:৩৪

দেশে প্রতিদিন গড়ে দুর্ঘটনায় সড়ক-মহাসড়কে ১১ জনের প্রাণহানি

চাকার নিচে জীবন

সাখাওয়াত হোসেন : মহাসড়ক কিংবা রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক, সর্বত্র প্রতিদিনই নির্মমভাবে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে যানবাহনের চাকার নীচে। দেশে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠেছে সড়ক দুর্ঘটনা। শিশু, মহিলা কিংবা ছাত্র সমাজের কেউ এখন আর নিরাপদ নেই সড়ক পথে। স্কুলে যাওয়ার পথে শিশু, কলেজ ছাত্রের হাত হারানো বা একমাত্র সন্তানকে রেখে পুরো পরিবারের মৃত্যুর ঘটনায় লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনায়। গতকাল দেশের ৫ জেলায় সড়ক ও রেল দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এ সব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২৫ জন। এর মধ্যে গাজীপুরে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে ৪ জন, নওগাঁয় ৫ জন, কিশোরগঞ্জে শিশুসহ ৪ জন, বরগুনায় ১ শিশু ও মানিকগঞ্জে ১ জন। বিভিন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে, দেশে প্রতিদিন গড়ে দুর্ঘটনায় সড়ক-মহাসড়কে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার পর দায়ী চালকদের বড় অংশই পার পেয়ে যায় পুলিশ ও মালিকদের গোপন সমঝোতায়। উপযোগি আইন করে সঠিকভাবে তার বাস্তবায়ন হলে চালকদের বেপরোয়াভাব কমবে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে- গাড়ির অতি গতি, গাড়ি চালানোর লাইসেন্স না থাকা, চালকের দক্ষতার অভাব, সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা, গাড়ির ফিটনেস না থাকা ইত্যাদি কারণ। এসব কারণেই সড়কে প্রতিনিয়ত ঝরছে প্রাণ। আর দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ নিয়ন্ত্রণহীন গতি।

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চেীধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশে প্রশিক্ষিত চালকের সংখ্য খুবই কম। প্রশিক্ষিত চালকের পাশাপাশি চালকদের সচেতন হতে হবে। একই সাথে পরিবহনের মালিককেও সচেতন হতে হবে। কেয়াল রাখতে হবে যে কার হাতে তিনি তার মুল্যবান গাড়িটি তুলে দিলেন। চালক যদি প্রশিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে সচেতন না হয় তা হলে জীবনহানী যেমন হয়, তেমনি অনেক দামি গাড়িটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চালক ও মালিকের পাশাপাশি আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সর্তক হতে হবে। চালকের সঠিক লাইসেন্স রয়েছে কিনা, গাড়ির সব ধরনের কাগজ আছে কিনা এ বিষয়ে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে। এক কথায় যানবাহনের মালিক, চালক ও পুলিশকে সচেতন এবং দায়িত্বশীল হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৬ হাজার মানুষ। ২০১৭ সালে মৃতের সংখ্যা কিছুটা কমে ৫ হাজারের ঘরে নামে। আর ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসেই দুর্ঘটনার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এসব দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব, অদক্ষ চালক, মাদক আর সড়কের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক কাজী সাইফুন নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের দেশের চালকরা বেশিরভাগই অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত। তারা একটু সুযোগ পেলেই বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান। একারণে দিন দিন সড়কে মৃত্যুর হার বাড়ছে। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব কমাতে হবে। এছাড়া তারা কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে গাড়ি চালাবেন তাদের সেই প্রশিক্ষণ দেয়া খুবই জরুরি।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভিন্ন থানার দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে গাড়ির অতিরিক্ত গতির কারণে। চালকদের বেপরোয়া চালনায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৭ শতাংশ। রাস্তাসহ অন্যন্য ত্রুটির কারনে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১০ শতাংশ। দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কে। ব্র্যাকের গবেষণা তথ্য বলছে, দেশের ১৬টি মহাসড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে আছে- চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-টাঙ্গাইল, যশোর-বেনাপোল, খুলনা-বরিশাল, খুলনা-যশোর এবং ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়ক। ব্র্যাকের গবেষণায় উঠে এসেছে, বছরে হাসপাতালে নেয়ার পথে ও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রাণহানি ঘটে কমপক্ষে দুই হাজার। মহাসড়কে দুর্ঘটনার ৯৫ শতাংশই ঘটছে ৫৭ কিলোমিটারের মধ্যে। দুর্ঘটনাপ্রবন এলাকার মধ্যে আছে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা।
রাজধানীতে সড়ক দুঘটনা
গত শুক্রবার ভোর থেকে সকাল ১০টার মধ্যে পৃথক দুর্ঘটনায় নিহত ৪। এদের মধ্যে পল্লবী থানা এলাকায় প্রাইভেটকারের ধাক্কায় ফারুক হোসেন (৪৫), ফার্মগেটে বাসের ধাক্কায় অজ্ঞাত (৫০) নিহত হয়েছেন। ফেনীতে যাত্রীবাহী বাসের চাপায় পুলিশ কনস্টেবল আলমগীর হোসেন (৫৬) নিহত হয়েছেন। গত ১২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কালেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। গত১১ এপ্রিল মধ্যরাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ছাগলনাইয়ার মুহুরীগঞ্জ এলাকায় দুর্ঘটনার শিকার হন এ পুলিশ কনস্টেবল। গত ১১ এপ্রিল দিনাজপুর শহরে বেপরোয়া ট্রাক কেড়ে নিল কলেজছাত্রের প্রাণ। ট্রাকের ধাক্কায় দিনাজপুর সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী সাদ্দাম ইসলাম (২০) নিহত হয়েছেন। দিনাজপুর কোতয়ালী থানার ওসি রেদওয়ানুর রহিম জানান, রাতে টিউশন শেষে বাইসাইকেলযোগে বাড়ি ফেরার সময় বটতলী এলাকায় পৌঁছালে একটি ট্রাক সাদ্দামকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। তৎক্ষণাৎ তাকে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রাতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাদ্দামের মৃত্যু হয়। গত ৩ এপ্রিল কারওয়ান বাজার এলাকায় দুই বাসের চাপায় কলেজ ছাত্র রাজীব ডান হাত হারান। গত ৫ এপ্রিল মেয়ে আহনাব আহমেদকে নিয়ে রিকশায় করে নিউমার্কেট থেকে ধানমন্ডির স্কুলে যাওয়ার পথে দুই বাসের চাপায় গুরুতর আহত হন আয়েশা খাতুন। তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ল্যাবএইড হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের কনসালট্যান্ট মাসুদ আনোয়ার জানান, আয়েশা খাতুনের মেরুদন্ড ভেঙে গিয়েছিল। সেটা অস্ত্রোপচার করে ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু তার স্পাইনাল কর্ড ড্যামেজ হয়ে গেছে। এ কারণে কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে আছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/126529