১৬ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ৯:১১

সমস্যায় ভরা ঢাকাতে পৌনে ২ কোটি মানুষ

দেখা অদেখা

বৈঠক ঘরটা সবাই সাজিয়েগুছিয়ে রাখে। নিজেদের ব্যবহারের পাশাপাশি অতিথি আপ্যায়ন এ ঘরেই হয়। তাই এ ঘরটিকে বিশেষ যতœ-আত্তি করেন সবাই। যেকোনো দেশের রাজধানীও অনেকটা তাই। রাজধানীকে গুছিয়ে এর শান্তিশৃঙ্খলা বিধানের প্রতি সরকারের মনোযোগ দেয়া একান্ত কর্তব্য। রাজধানীসহ বড় শহর বন্দরগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধন, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা সরকারের এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের রাজধানী অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খল এবং হাজারো সমস্যা নিয়ে বসবাস করেন এ শহরের অধিবাসীরা। শুধু সমস্যাই নয়, নানা কারণে আতঙ্কিত থাকেন এ শহরের মানুষ। প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা, খুন, গুম, অপহরণ, নারী-শিশু নির্যাতন, ছিনতাইয়ের বেশুমার সব খবর। তাই নগরবাসীর জীবন এখন এসব নিয়ে ক্লান্তিকর এবং দুশ্চিন্তায় ভরে আছে। সুস্থ কিংবা স্বস্তিতে থাকার উপায় নেই। যানজটে পথচলার উপায় নেই, ফুটপাথ বেদখল এবং ঘর থেকে রাস্তায় বেরোলেই থাকে দুর্ঘটনার আশঙ্কা। ঘর থেকে বের হলে দিনের একটা বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায় পথে পথে। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। সেই সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা ও সরঞ্জাম অনেকগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় নগরবাসীর স্বস্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাড়েনি। এসব জনভোগান্তি নিয়ে কেউ ভাবেন বা বিহিত ব্যবস্থা করার চিন্তা করেনÑ অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হয় না। নগরের মেয়র রয়েছেন, কর্মকর্তা রয়েছেন বহু। কিন্তু ঢাকা সেই তিমিরেই। রাজধানীসহ বিভিন্ন নগরে যারা বসবাস করেন তারা এসব সমস্যায় হাঁপিয়ে ওঠেন এবং হতাশায় ভোগেন। তারা ভেবে পান না এসব সমস্যা প্রতিবিধান কখন কিভাবে হবে। তা তাদের জানা নেই। এটা জানানোর কেউ আছে বলেও বোঝা যায় না।

সরকারিভাবে বলা হচ্ছেÑ দেশ উন্নতি করছে এবং মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে এ আয়-উন্নতি কি মানুষের খুব কাজে আসছে? দেশের বিপুল মানুষের বসবাস এ ঢাকায়। এ মহানগরীতে প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের বসবাস। আর এ রাজধানী শহর পৃথিবীর তৃতীয় ব্যয়বহুল নগরী। তাই এ নগরীতে সরকারি ভাষ্যের সাথে জীবনযাপনের সামঞ্জস্য নেই বাসিন্দাদের। উন্নয়ন শুধু বললেই হবে না, তা জীবনের সব ক্ষেত্রকে স্পর্শ করতে হবে। মানুষের আয় বাড়ছে ঠিকই; কিন্তু তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যয় ঠিক থাকছে না। তাই উন্নতি উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। উন্নয়নের একটি বিষয় হচ্ছেÑ নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তো বৃদ্ধি পায়নি, বরং হ্রাস পেয়েছে।

এ দিকে, ঢাকাবাসীকে দু’টি খারাপ খবর দিয়েছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের গবেষণা শাখা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। খবরটি হলোÑ বসবাসের জন্য ঢাকা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরগুলোর কাছাকাছি। সম্প্রতি বিশ্বের ১৪০টি শহরের যে তালিকা তারা প্রকাশ করেছেন, তাতে ঢাকার অবস্থান ১৩৮ নম্বরে। তালিকার সর্বশেষ অর্থাৎ ১৪০ নম্বর দেশটি হলো জিম্বাবুয়ের হারারে। ঢাকা আর হারারের মধ্যে রয়েছে শুধু পাপুয়া নিউগিনির বন্দরনগরী মোর্সবি। বাসযোগ্যতার বিচারের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছেন জরিপকারীরা। এগুলো হলো স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো।

ঢাকায় পুরুষ নাগরিকদের প্রতিদিন হাজারো ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। সে দিক থেকে ঢাকার নারী অধিবাসীদের অবস্থা কেমন? যৌন সহিংসতা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, তাদের প্রতি সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অর্থনৈতিক সুযোগÑ এসব বিষয়ে ঢাকা শহরের নারী কতটা ভালো আছেন? আন্তর্জাতিক সংস্থা থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, উল্লিখিত চার মানদণ্ডে ঢাকার অবস্থান গড়ে ভালো নয়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নারীদের জন্য ভয়ঙ্কর শহরের তালিকায় বিশ্বের ১৯ মেগাসিটির মধ্যে ঢাকা সপ্তম। প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের এই শহরে নারীর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা এবং তাদের হয়রানির চিত্র খুব খারাপ। ইদানীং লক্ষ করা গেছে, মেয়ে শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। নি¤œ আয়ের পরিবারগুলোর মেয়েরা বেশি সমস্যায় পড়ছে। পোশাক শিল্পে যেসব কিশোরী কাজ করে, তারাও এই সমস্যায় রয়েছে।

এখন ঢাকা শহরের এক নম্বর সমস্যা কোনটি, যদি এই প্রশ্ন করা হয়, তবে সবাই এক বাক্যে বলবেন, যানজট প্রধান সমস্যা। রাস্তার তুলনায় ঢাকায় যানবাহনের আধিক্য। একটি আধুনিক শহরে মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ জায়গায় রাস্তা বা সড়ক থাকা প্রয়োজন, কিন্তু ঢাকায় রয়েছে মাত্র সাত থেকে আট শতাংশ। এর অর্থ হলো, প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সড়ক রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানীতে। ঢাকা মহানগরীর এলাকা ১৩৫৩ বর্গ কিলোমিটার। আর এই শহরে রাস্তার দুই হাজার ২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে মাত্র ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। ট্রাফিক বিভাগের হিসাব মতে, সেই সড়কের কম করে হলেও ৩০ শতাংশ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিংসহ অবৈধ দখলদারদের হাতে। এ ছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই হেঁটে চলতে হয় নগরবাসীকে। ফলে যানজটের সাথে রয়েছে জনজট। এ ছাড়া বিভিন্ন সড়কে নানা সমাবেশ মিছিল মিটিংয়ের ফলে রাস্তায় সৃষ্টি হয় মারাত্মক যানজট। শহরবাসী রাস্তায় চলাচলের সময় নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলেন না। ফলে যানবাহনের গতি হয়ে পড়ে শ্লথ।

ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে এখনো রেলগাড়ি চলাচল করে। ফলে ২৭টি স্থানে রাস্তা বন্ধ করে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এসব স্থানে দিনে কমপক্ষে ১০ বার যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। এটি একটি স্থায়ী ও বড় সমস্যা। এর সাথে আছে ভিআইপি চলাচল। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও মন্ত্রীদের চলাচলের সময় দীর্ঘক্ষণ কিছু সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে শুধু তাদের চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই সে সময় পার্শ¦বর্তী সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় ৯ লাখ ১৩ হাজার ৬২২টি নিবন্ধিত মোটরযান রয়েছে। এর মধ্যে বাস ২৩ হাজার ১১৯টি এবং মিনিবাস ১০ হাজার সাতটি। প্রাইভেট কার রয়েছে দুই লাখ ১৬ হাজার ৭২২টি।

ঢাকা মহানগরবাসী নানা দুর্ভোগ নিয়ে এই শহরে বসবাস করে। এর সাথে রয়েছে আরো একটি দুঃসংবাদ, সেটা হলো আগামীতে ঢাকায় শব্দদূষণে নগরীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যাবে। পুরো ঢাকা শহরই এখন শব্দদূষণের শিকার। শহরের প্রায় সব এলাকাতেই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ বধিরতায় আক্রান্ত হবেন। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই নেই ঢাকায়। শব্দের মাত্রার একককে বলা হয় ডেসিবেল। বিশ্ব সংস্থার মতে আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনে ৫৫ ডেসিবেল ও রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল ও রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল ও রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে থাকা উচিত। আর হাসপাতাল তথা সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা থাকা উচিত। ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট ঢাকা শহরের ১০টি স্থানে শব্দ পরিমাপ করে দেখেছেÑ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে গড়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। পুরো ঢাকা শহরে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক।

জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল এভিনিউতে শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবেল, মিরপুর-১ এ সর্বোচ্চ ৯৬ ডেসিবেল, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবেল, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউ মার্কেটের সামনে সর্বোচ্চ ১০৪ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবেল। নাক, কান ও গলা সম্পর্কিত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ সম্পর্কে বলেন, ‘এক গবেষণায় দেখা গেছে এভাবে শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিনজনে একজন কানে কম শুনবেন। একটি অংশ পুরোপুরি বধির হয়ে যেতে পারেন। তিনি বলেন, শাহবাগ, মহাখালী বা ফার্মগেট এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা ১২০ ডেসিবেল পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিন্তু ওসব এলাকায় ৬০ ডেসিবেল হওয়া উচিত। ঢাকা শহরের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে শব্দমাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। অক্সিজেন যদি বিশুদ্ধ না হয় তবে শরীরে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ দেখা দেয়। হাঁপানি এবং ফুসফুসে ক্যান্সারের জন্য অন্যতম দায়ী বায়ুদূষণ। ঢাকায় এখন মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কখনো কখনো ঢাকার এ দূষণ দিল্লিকে ছাড়িয়ে যায়। গত এক দশক যাবত ঢাকায় দূষণের মাত্রা বেড়ে এখন তা ‘মাঝারি’ ক্ষতির পর্যায়ে এসেছে। অবশ্যই এটা রাজধানীবাসীর জন্য এটি বড় দুঃসংবাদ। জানা যায়, ঢাকার যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বায়ু মানযন্ত্রে বায়ুর মান ১৯৭, যা আশঙ্কাজনক। ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণে শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। বিশ্বে যে ক’টি শহরে সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষিত তার মধ্যে ঢাকার নাম রয়েছে। ঢাকার আশপাশে বহু ইটভাটা রয়েছে বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ। নির্মাণকাজের ও সড়কের ধুলা এবং মানহীন গাড়ির ধোঁয়া নগরীর বায়ুকে দূষিত করে তুলছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য বছরে ৭৫০ কেজি অক্সিজেন দরকার হয়। এ পরিমাণ অক্সিজেনের জন্য সাত-আটটি বড় গাছের দরকার কিন্তু এই নগরীতে তা নেই। অথচ ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার গাছ কাটা হয়। শুধু ভারী বাতাসের জন্যই নয়, মহানগরীর মানুষের বিনোদন ও ঘুরে বেড়ানোর জন্য যত পার্ক থাকা দরকার সেটা ঢাকায় নেই। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বায়ুতে দূষণের মাত্রা সহনীয়পর্যায়ের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে জানা গেছে, ঢাকার বাতাসে সিসাজনিত দূষণ জাতিসঙ্ঘের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রার চেয়ে কমপক্ষে কয়েক হাজার গুণ বেশি। আরেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বিশ্বের ১৬০০ শহরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ বায়ুর শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ২৩তম। হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজারের বেশি মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুবরণ করে।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/310522