১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ৫:০৬

সংকটে পড়া ব্যাংকের দায়িত্ব নেবে সরকার

বেসরকারি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়লে প্রয়োজনে তা জাতীয়করণ করতে পারবে সরকার। পরে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকটি পরিচালনার পাশাপাশি নতুন ক্রেতার কাছে তা বিক্রি করে দেবে। পুরোপুরি জাতীয়করণ না করেও সরকার চাইলে অর্থ জোগান দিয়ে ওই ব্যাংকের শেয়ারের মালিক হতে পারবে। আবার সংকটাপন্ন ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধও করে দিতে পারবে। তবে এতে টাকা খোয়ানোর ভয় থাকবে না আমানতকারীদের। সরকার এর দায়িত্ব নেবে। আর কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার কারণে বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য অন্য ব্যাংক বা ভিন্ন উৎস থেকে অর্থের জোগান নিশ্চিত করবে সরকার।
এসব বিধান রেখে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা ও পুঁজিবাজারসহ সার্বিক আর্থিক খাতের জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি গ্রুপ গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। এর নাম হবে ফিন্যানশিয়াল স্ট্যাবিলিটি গ্রুপ (এফএসজি)। ওই গ্রুপের সভাপতি হবেন অর্থমন্ত্রী। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ সংশোধন করা হবে। গভর্নর, অর্থ বিভাগের সচিব, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (ইডরা) চেয়ারম্যান, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান, সমবায় অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রার ও মহাপরিচালক সদস্য হিসেবে থাকবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর এ গ্রুপে সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এফএসজি গঠনের ধারণাপত্রটি এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে গেছে।
ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় এফএসজি কার্যকর রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) নেওয়ার সময় বাংলাদেশকে এমন একটি গ্রুপ গঠনের শর্ত দেয় সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালে একই প্রস্তাব দিয়েছিল। দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এ ধরনের গ্রুপ গঠন যৌক্তিক বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংকও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক দেবাশিস চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক ও আর্থিক খাত রক্ষায় বাংলাদেশে একটি শীর্ষ কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত, যারা সংকটকালে সমাধানের পথ বাতলে দেবে। বাংলাদেশে কার্যরত সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংকট প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কাজ করবে গ্রুপটি। সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ, সংকটকালীন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়ন (বন্ধ করে দেওয়া) বা পুনর্গঠন ছাড়াও গ্রুপটি বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থার সংকটকালে মুদ্রাবাজারসহ সামগ্রিক আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় কাজ করবে। ’
ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বাঁচাতে প্রতিবছরই জনগণের করের অর্থ ঢেলে দিচ্ছে সরকার। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। একটি ব্যাংক ধ্বংস হলে তা সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জনগণের আস্থা ধরে রাখতে সংকট মোকাবিলায় অর্থের জোগান, সুরক্ষার ঘোষণা বা জাতীয়করণ করার মাধ্যমে সংকট সমাধান করা যায়। কিন্তু স্থিতিশীলতার সময় একটি বড় ব্যাংকের পতন অর্থনীতিতে ধস নামাতে পারে। শুধু অর্থ জুগিয়ে এ অবস্থায় আর্থিক খাতের ওপর আস্থা ও মানুষের প্রত্যাশায় চিড় ধরানো বিলম্বিত করা গেলেও মন্দা ঠেকানো যাবে না। তাই জনগণের টাকা দিয়ে টিকিয়ে না রেখে ব্যাংকগুলোকে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে মুনাফানির্ভর করতে হবে। ’
ব্যাংকিং খাতের উন্নয়ন, ব্যাংকের অবস্থান মূল্যায়ন ও সরকারের নীতিগুলো পর্যালোচনা করবে এফএসজি। এ ধরনের নীতির মধ্যে থাকবে তারল্য সহায়তা, আর্থিক সিস্টেম ধরে রাখতে জনগণের অর্থ ব্যয় করা হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় করণীয় নির্ধারণ ইত্যাদি। অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে কার্যরত ব্যাংকগুলোকে এফএসজি তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করবে—শক্তিশালী (সাউন্ড), দুর্বল কিন্তু টিকে থাকার মতো (উইক বাট ভায়াবল) এবং টিকে থাকার মতো নয় এমন (ননভায়াবল) ব্যাংক।
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘শেষ দুই শ্রেণির ব্যাংকের জন্য এফএসজি কিছু কর্মসূচি দেবে। তার মধ্যে দুর্বল কিন্তু টিকে থাকার মতো ব্যাংকগুলোর জন্য শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে পুনঃমূলধন জোগানের ব্যবস্থা করা, সর্বনিম্ন মূলধন নিশ্চিত করতে টাইমবাউন্ড কর্মসূচি প্রণয়ন, পুনঃমূলধন কাজে সরকারি অর্থের জোগান দেওয়ার দিকগুলো চিহ্নিত করা, মুনাফা বাড়ানোসহ স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পরিচালনগত নীতি আরোপ এবং মূলধন নিশ্চিত করতে না পারা ও পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে জরিমানা করা। আর ননভায়াবল ব্যাংকগুলোর সম্পদ বিক্রিসহ তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কোনো ধরনের নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে এই গ্রুপের অনুমোদন নিতে হবে ব্যাংকগুলোকে, তা না হলে দায়-দেনা পরিশোধে আইনি বাধার মুখে পড়বে ব্যাংক। ’
‘একটি বিপদগ্রস্ত ব্যাংক রক্ষায় সরকার তার বেশির ভাগ মালিকানা বা পুরোটাই নিজের করে নিয়ে জাতীয়করণ করলেও তা একটি সাময়িক সমাধান। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ওই ব্যাংকের জন্য আগ্রহী ক্রেতা খোঁজা। অন্তর্বর্তীকালে সরকার ব্যাংকটি প্রচলিত আইন মেনে পরিচালনা করবে। ওই সময় সরকার অবশ্যই অন্যান্য ব্যাংক ও জনগণের কাছে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করবে’, যোগ করা হয়েছে ধারণাপত্রে।
গত ২৩ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমানের কাছে পাঠানো ধারণাপত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘ব্যাংকগুলোর সংকট মোকাবিলায় সরকারের অর্থের জোগান দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে সর্বশেষ উপায় হিসেবে। অগ্রাধিকার দিতে হবে বেসরকারি খাত থেকে অর্থের জোগান নিশ্চিত করার ওপর। শেয়ারহোল্ডাররা পুরো ক্ষতির দায় বহন করবে। সুপারভাইজাররা সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করবে। শেয়ারহোল্ডাররাই পুনঃমূলধনের জোগান দেবে। তবে একান্ত প্রয়োজনে সরকার অর্থের জোগান নিশ্চিত করবে এবং তার ওপর একটি ইতিবাচক সুদহার আরোপ করবে। এমন একটি শর্ত তাতে রাখা হবে, যেখানে বলা থাকবে, শেয়ারহোল্ডাররা সরকারের দেওয়া অর্থের অপচয় করলে বা ব্যাংক পুনর্গঠনে ব্যর্থ হলে ব্যাংকটি রাষ্ট্রের মালিকানায় চলে যাবে। ’
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর স্বাধীনতায় এই গ্রুপ হস্তক্ষেপ করবে না। তবে আর্থিক খাতে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে ওই বিষয়ে প্রথম সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দেবেন অর্থমন্ত্রী বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এরপর সরকারের অবস্থান তুলে ধরবেন মুখপাত্র। কোন ক্ষেত্রে কে সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করবে, এফএসজি তা ঠিক করে দেবে। বিপদে পড়া প্রতিষ্ঠান রক্ষায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে সময় সময় জানানো হবে। জরুরি প্রয়োজনে মন্ত্রিসভা ও সংসদে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এতে বলা হয়েছে, সংকটময় মুহূর্তে বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা ও আস্থায় যাতে ধস না নামে, সেটা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে এফএসজি। কোনো সংকট দেখা দিলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, মুদ্রানীতি, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ওঠানামার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ জন্য একটি উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণ করবে গ্রুপ।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়লে, বন্ধ হলে আমানতকারী যাতে দুশ্চিন্তায় না পড়ে, সে জন্যও কাজ করবে এফএসসি। ধারণাপত্রে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘যেকোনো আর্থিক সংকটে এই গ্রুপ আমানতকারীদের নিশ্চিত করবে যে তাদের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ আছে। সংকটময় পরিস্থিতিতে এ ধরনের ঘোষণা দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নেওয়া হবে। একটি ব্যাংক ধ্বংসের মতো সংকট দেখা দিলে আমানতকারীদের আস্থা ধরে রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্য কোনো খাতে সংকট দেখা দিলে তখন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানাবে এফএসজি। ’
ব্যাংকগুলোতে সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন খাতে কোন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তাও উঠে এসেছে এফএসজি গঠনের ধারণাপত্রে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘আক্রান্ত কোনো ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ হলে কিছু বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। কোনো ব্যাংকের তারল্য সংকট চরম পর্যায়ে গেলে এ ধরনের হস্তক্ষেপ করা হবে। আবার কোনো কোনো ব্যাংক বাতিল বা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করাও হতে পারে। একটি কারিগরি গ্রুপ থাকবে, যারা ব্যর্থ বা বাতিল ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতির মাত্রা চিহ্নিত করে এফএসজিকে জানাবে। তখন এফএসজি সিদ্ধান্ত নেবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কিভাবে অর্থের জোগান দেওয়া হবে বা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেবে। কারিগরি গ্রুপটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট (বিআরপিডি), ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপারভিশন (ডিওএস), ডেবট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট (ডিএমডি), মনিটরি পলিসি ডিপার্টমেন্ট (এমপিডি) এবং গবেষণা ও পরিসংখ্যান ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা থাকবেন।
এফএসজির অধীনে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ থাকবে, যারা বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও এর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই গ্রুপ বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, ইউরোজোন সংকট পর্যালোচনা করে এর থেকে কিভাবে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখা যাবে, সেই পরামর্শ দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এফএসজিকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার মতো কোনো আইন দেশে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর ৯এ ধারায় কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল গঠনের কথা বলা আছে। এফএসজি গঠনে আইনগত সমস্যা দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে এফএসজি গঠনের বিষয়ে আরেকটি ধারা সংযোজন করা যেতে পারে। অথবা যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিয়ে এফএসজি গঠন করা হবে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করলেও হবে।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/02/11/462317