আসিফা বানুর হত্যাকরীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে কশ্মিরের বিক্ষোভে যোগদেয় এই শিশুটি
১৪ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ৯:২১

শিশু আসিফার জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে উত্তাল ভারত

জম্মু ও কাশ্মীরে আট বছরের এক শিশুকে দলবেঁধে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় আবারও ভারত জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিবিসি জানায়, গত ১০ জানুয়ারি কাশ্মীরের কাঠুয়া শহরের কাছে মুসলিম যাযাবর সম্প্রদায়ের আসিফা বানু নিখোঁজ হয়। ৭ দিন পর কাছের একটি জঙ্গলে তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়।

তদন্তে ঘটনার যে বিবরণ উঠে এসেছে, তা এক কথায় বীভৎসতার চূড়ান্ত পর্যায়। এও বলা হয়েছে চাজর্শিটে, যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী যাযাবর সম্প্রদায়কে হিন্দু প্রধান এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আর তাদের মনে আতঙ্ক তৈরি করার জন্য ঐ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। অপহরণ, ধর্ষণ আর হত্যার ঐ মামলায় আট জন অভিযুক্তের মধ্যে চার জন পুলিশ কনস্টেবল বা কর্মকর্তা। এদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার ১৯ বছরের এক তরুণের জবানবন্দীর ভিত্তিতে তার চাচা মন্দিরের (যে মন্দিরে আসিফাকে আটকে রেখে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়) পরিচালক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা সানজি রাম এবং পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়াকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার চতুর্থ ব্যক্তি স্পেশাল পুলিশ অফিসার সুরিন্দর কুমার। তাকে প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনাস্থলে দেখছিল। ওই তরুণের বন্ধু প্রবেশ কুমারও শিশুটিকে ধর্ষণ করেছে। তাকে খুঁজছে পুলিশ।
পুলিশী তদন্ত এবং ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহকরা নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষায় অভিযুক্তদের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় বলে জানায় এনডিটিভি। তিন মাস আগের এ ঘটনা নিয়ে এ সপ্তাহে ভারত জুড়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়। কারণ, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হিন্দু হওয়ায় হিন্দু অধ্যুষিত জম্মুর কয়েকটি হিন্দু রাইট-উইং গ্রুপ তাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। বিবিসি জানায়, জম্মুর হিন্দু আইনজীবীদের একটি দল পুলিশকে আদালতে আসিফা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিলে বাধা দেয়। অভিযুক্তদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পুলিশকে মোটা অংকে ঘুষের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল, অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে জানায় এনডিটিভি।
এমনকি প্রমাণ লোপাট করতে পুলিশের উপ-পরিদর্শক আনন্দ দত্ত এবং প্রধান কন্সটেবল তিলক রাজ গুরত্বপূর্ণ প্রমাণ সংগ্রহ করেনি এবং আসিফার পোশাক ধুয়ে ফেলেন বলেও অভিযোগপত্রে বলা হয়।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দুই মন্ত্রী অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে করা মিছিলে অংশ নেন বলেও জানায় এনডিটিভি। শুধুমাত্র ধর্মের কারণে এরকম নৃশংস একটি ঘটনার পরও অভিযুক্তদের মুক্তি দাবি এবং ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীদের তা সমর্থন করায় পুরো ভারত ক্ষোভে ফেটে পড়ে। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানী দিল্লিতে আসিফা হত্যা মামলায় ন্যায় বিচারের দাবিতে ইন্ডিয়া গেট অভিমুখে ‘ক্যান্ডেললাইট মার্চের’ নেতৃত্ব দেন ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস পার্টির প্রধান রাহুল গান্ধী।

রাহুল বলেন, “আমরা কি দেখছি, এদেশে নারী ও শিশুরা ক্রমাগত ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা জাতীয় বিষয়।”
সোনিয়া গান্ধী এবং প্রিয়াংকা ভদ্র গান্ধীও ওই প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেন। নারী ও শিশুদের অধিক সুরক্ষার দাবিতে দিল্লি কমিশন ফর উইম্যান এর প্রধান গতকাল শুক্রবার থেকে আমরণ অনশনে বসার ঘোষণা দিয়েছেন।

কি ঘটেছিল আসিফার সঙ্গে:
গ্রেফতার তরুণের জবানবন্দিতে ভয়ঙ্কর নৃশংসতার কথা উঠে আসে। ওই তরুণ একটি ঘোড়া খুঁজে দিতে সাহায্য করার কথা বলে আসিফাকে জঙ্গলে ডেকে নিয়ে যায়। পরে সে আফিসাকে জোর করে গ্রামের একটি ছোট্ট মন্দিরে টেনে নিয়ে যায় এবং নেশাদ্রব্য খাইয়ে দেয়।
ওই তরুণ, মন্দিরের পরিচালক সানজি রাম ও পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়া শিশুটিকে তিন দিন ধরে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। ওই তিনদিন শিশুটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখ হয়েছিল এবং কিছু খেতে দেওয়া হয়নি।
পরে তারা ভারি পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে আসিফাকে হত্যা করে তার লাশ জঙ্গলে ফেলে দেয়।
সোচ্চার বলিউড : ৮ বছরের কন্যা শিশু আসিফাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে সে দেশের অভিনয় শিল্পীরা। অভিষেক বচ্চন থেকে শুরু করে জাভেদ আখতার, ফারহান আখতার, স্বরা ভাস্কর, অতুল কাসবেকর, হংসল মেহতা, বিশালা দালানি- সবাই দাবি তুলেছেন ন্যায়বিচারের।

আসিফার জন্য ন্যায়বিচার দাবি করে বলিউড অভিনেতা জাভেদ আখতার লিখেছেন, 'মহিলাদের সুরক্ষার পক্ষে সওয়াল করার এটাই সেরা সময়, সকলে এগিয়ে এসে মুখ খুলুন।' অভিষেক বচ্চন তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে আসিফার ছবি পোস্ট করে সঙ্গে হ্যাসট্যাগ আসিফা বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পরিচালক হংসল মেহতা নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি লেখা রিটুইট করেছেন। এই লেখায় নিউ ইয়র্ক টাইমস বিস্তারিতভাবে আসিফার হত্যা কাহিনি বিবৃত করেছে এবং দেখিয়েছে কীভাবে হিন্দুরা এই নৃশংসতার প্রতিবাদের নামে আসল দোষীদের আড়াল করছে। হংসল তার শেয়ার করা পোস্টের তলায় প্রশ্ন তুলেছেন এটাই কি জাতীয়তাবাদ ?

সোনম কাপুর সোশ্যাল মিডিয়ায় আসিফার হত্যার ঘটনায় জড়িত হিন্দু এবং তাদের বাঁচানোর চেষ্টায় কসরত করে চলা হিন্দুদের কড়া বার্তা দিয়েছেন। তিনি তাঁর টুইটে মিথ্যা দেশপ্রেমিক ও জাল হিন্দু বলে দুটি শব্দও ব্যবহার করেছেন। এই মিথ্যা দেশপ্রেম ও জালি হিন্দুদের জন্য তাঁর লজ্জা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন সোনম। তাঁর দেশে এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে তা কল্পনাতেও নাকি তিনি আনতে পারছেন না বলে টুইটারে করা পোস্টে লিখেছেন সোনম। পরিচালক, প্রযোজক ও অভিনেতা ফারহান আখতারও এই ঘটনার কড়া নিন্দা করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'একবার ভেবে দেখুন একটি ৮ বছরের মেয়েকে টেনে-হিঁচড়ে, ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং বন্দী বানানো হচ্ছে। দিনের পর দিন তাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে এবং শেষে তারা তাকে খুন করছে। যদি এরপরও আপনি তাঁর আতঙ্ককে অনুভব করতে না পারেন তাহলে আপনি মানুষ-ই নন। আপনি যদি আসিফার জন্য বিচার পেতে সওয়াল করেন তাহলে আপনি কিছুই নন।'

অভিনেত্রী স্বরা ভাস্কর সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, একটা ৮ বছরের শিশুকে অপহরণ করে মন্দিরে গণধর্ষণ করে খুন করা হল। কারণ, সে সেই মুসলিম পরিবারের মেয়ে যাদের কে এলাকা থেকে উৎখাত করতে চাইছিল হিন্দুত্বের মৌলবাদীরা।' অভিনেতা রীতেশ দেশমুখ লিখেছেন, '৮ বছরের মেয়েকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও খুন করা হল এবং তার বিচারের জন্য লড়াই করা বাবার পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু। আমাদের হয় আসিফার জন্য গলা চওড়া করতে হবে না হলে নীরব দর্শকের মতো থাকতে হবে। উঠে দাঁড়ান, সেরকম হলে একা একাই আওয়াজ ওঠান।' চলচ্চিত্র পরিচালক শীর্ষ কুন্দর তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে লিখেছেন,'দয়া করে এই লেখাটা পড়ুন। যদি আপনার রক্ত গরম হয়ে ওঠে তাহলে এই লেখাটা শেয়ার করুন। এটাই সঠিক সময় কারণ একদল কিছু শয়তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। মানবিকতা আজও বেঁচে আছে আমাদের সেটা প্রমাণ করতে হবে।'
অক্ষয় কুমার তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'সমাজ হিসাবে আমরা ব্যর্থ। আসিফার নিস্পাপ মুখটা আমাকে লড়াই থেকে সরে আসতে বাধা দিচ্ছে। যে কোনও মূল্যে বিচার পাওয়া উচিত।' অভিনেত্রী দিয়া মির্জা লিখেছেন, 'আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছে। রাগে ও ক্ষোভে আমি ফুঁসছি। আসিফা-কে কতটা নৃংসতা সহ্য করতে হয়েছে ভেবে আমি ভেঙে পড়েছি। একদল অপরাধী যারা আমাদের মনের ঐক্যকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে!'

http://www.dailysangram.com/post/326563