১০ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:৫২

সংসদের মেয়াদ ও ভেঙে যাওয়া সংসদ আহ্বান

সুশাসন

ইকতেদার আহমেদ
রাষ্ট্রপতি সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংসদের অধিবেশন আহ্বান ও স্থগিত করেন এবং সংসদ ভেঙে দেন। সংসদের অধিবেশন আহ্বানকালে রাষ্ট্রপতি প্রথম বৈঠকের সময় ও স্থান নির্ধারণ করে দেন; তবে রাষ্ট্রপতি সম্পাদিত এ সামগ্রিক কার্যক্রমটি রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শানুযায়ী সম্পন্ন করে থাকেন।

সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অধিক বিরতি থাকার অবকাশ নেই; তবে মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে উপরিউল্লিখিত বিধান প্রতিপালন অত্যাবশ্যক নয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে যে বিধান চালু করা হয় তাতে বলা হয়Ñ মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নতুন চালু বিধানের ফলে সংসদ নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করলে সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ বিধান প্রবর্তন পরবর্তী বিগত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন সংসদ বহাল থাকাবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও সে নির্বাচনটি সংসদের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বর্জন করায় সেটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না। সে নির্বাচনটির সবচেয়ে নেতিবাচক দিক ছিল একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমন নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(২)-এর শর্তাংশ পূরণ হয় কি না, তা প্রণিধানযোগ্য।

সংসদের যেকোনো সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে সংসদের বৈঠক ডাকতে হয়। সংসদের যেকোনো সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত এবং একজন ব্যক্তি একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে সর্বাধিক সংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়া পরবর্তী নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সরকারিভাবে নির্বাচিত নন।

রাষ্ট্রপতি পূর্বে সংসদ ভেঙে না দিয়ে থাকলে সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ আপনাআপনি ভেঙে যায়; তবে এ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭২(৩)-এ যে শর্তাংশ যুক্ত হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছেÑ রাষ্ট্র যুদ্ধে লিপ্ত থাকলে সংসদের আইন দিয়ে অনুরূপ মেয়াদ এককালে অনধিক এক বছর বাড়ানো যাবে এবং যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়া পরবর্তী বর্ধিত মেয়াদ কোনোক্রমে ছয় মাসের বেশি হবে না। উল্লিখিত বিধানটি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে অনুরূপ মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানোর বাধা নেই। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কখনোই ওই বিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন হয়নি। এই অনুচ্ছেদের দফা (৩)-এর শর্তাংশে উল্লিখিত যুদ্ধ শুধু বিদেশী অপর কোনো রাষ্ট্র দিয়ে আক্রান্ত হওয়াকে আকৃষ্ট করে নাকি গৃহযুদ্ধ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগও অনুরূপ যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত এ বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। উল্লেখ্য, জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষেত্রে বিষয়টিকে শুধু যুদ্ধের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ অবধি বিস্তৃত করা হয়েছে।

সংবিধানের বিধান অনুযায়ী যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে বাংলাদেশ বা এর যে কোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদাপন্ন হলে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে অনধিক ১২০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় জরুরি অবস্থা জারি করা হলে অথবা জরুরি অবস্থা জারি পরবর্তী ১২০ দিনের পূর্বেই সংসদ ভেঙে গেলে সংসদ পুনর্গঠিত হওয়ার পর ৩০ দিন অতিবাহিত হওয়ার আগে ঘোষণাটি সংসদে অনুমোদিত না হলে উল্লিখিত ৩০ দিনের অবসানে অনুরূপ ঘোষণা কার্যকারিতা হারায়। উপরোল্লিখিত বিধান থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলে অথবা জরুরি অবস্থা ঘোষণা পরবর্তী ১২০ দিন পার হওয়ার আগেই সংসদ ভেঙে গেলে জরুরি অবস্থার ব্যাপ্তিকাল দীর্ঘতর হওয়ার বিষয়ে কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে যেসব মৌলিক অধিকারের বিষয় উল্লেখ রয়েছে, সে অধিকারগুলো কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রের যেকোনো সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু জরুরি অবস্থা বহাল থাকা অবস্থায় উল্লিখিত সব অধিকার বা যেকোনো অধিকার স্থগিত করার অবকাশ রয়েছে।
সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর এবং সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে রাষ্ট্রপতির কাছে যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্র যে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, সে যুদ্ধাবস্থার বিদ্যমানতার কারণে সংসদ পুনরাহ্বান করা প্রয়োজন, তাহলে যে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতি তা পুনরাহ্বান করতে পারবেন।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পরবর্তী সংসদের সরকারি ও বিরোধী দলের সম্মতির ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল থাকাকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রপতি সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতেন এবং প্রজাতন্ত্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে প্রযুক্ত হতো। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার-ব্যবস্থা প্রবর্তন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হন এবং প্রজাতন্ত্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রযুক্ত হয়। বর্তমান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার-ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার অপর সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শানুযায়ী সম্পন্ন করে থাকেন। উল্লিখিত উভয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অবকাশ নেই বললেই চলে। প্রথমোল্লিখিত ক্ষেত্রে শুধু যিনি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন তাকে ব্যতীত অপর কাউকে রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দানের সুযোগ নেই। শেষোল্লিখিত ক্ষেত্রে একাধিকবার প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারককে অতিক্রান্তের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। এরূপ অতিক্রান্তের বিষয় কার্যকরের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা কখনো প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষার পরিপন্থী ছিল কি না, এমন প্রশ্ন উত্থাপন বাস্তবতার নিরিখে অনেকটাই সম্ভাবনার বিপরীত।

সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর আকাক্সক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ লাভ করেন এবং অলিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টিসাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকেন। সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি পদে বহাল থাকেন।

সংসদের মেয়াদ বাড়ানো এবং ভেঙে যাওয়া সংসদ পুনরাহ্বান এই উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানের বিধানাবলির আলোকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শানুযায়ী করতে হবে। আমাদের দেশ ইতোপূর্বে কখনো উভয় পরিস্থিতির কোনোটির মুখোমুখি না হলেও, ভবিষ্যতে যে হবে না এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সংসদ বহাল থাকাবস্থায় বা সংসদ ভেঙে দিয়ে যে অবস্থায়ই সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হোক না কেন, তা ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে নিজ পদে অধিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে কোনো ধরনের বিপত্তির উদ্ভব ঘটায় না। আর তাই সংবিধানের বর্তমান বিধানাবলির আলোকে প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ রাষ্ট্রপতির নেই।

আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর দীর্ঘ চার যুগ অতিক্রম করে পঞ্চম যুগে পদার্পণের পথে অগ্রসর হচ্ছি। এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কখনো সংসদের মেয়াদ বাড়ানো বা ভেঙে যাওয়া সংসদ পুনরাহ্বানের প্রয়োজন হয়নি। রাষ্ট্র যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বিশৃঙ্খলাকে যুদ্ধাবস্থা আখ্যায়িত করে সংসদের মেয়াদ বাড়ানো বা ভেঙে যাওয়া সংসদ পুনরাহ্বানের প্রয়াস নেয়া হলে তা এ দেশের গণতন্ত্রের নাজুক ভিতকে আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেবে। সুতরাং বহিঃশত্রুর আক্রমণের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাবস্থা ছাড়া অপর কোনো অজুহাতে এ পথে অগ্রসর প্রত্যাশার চেয়ে অনিশ্চয়তাকেই হাতছানি দেয়।
লেখক : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/308994