চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর রাতে পুলিশের টিয়ার শেল
৯ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ৯:১০

শাহবাগ রণক্ষেত্র

আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ার শেল; অর্ধশতাধিক আহত; গভীর রাত পর্যন্ত সংঘর্ষ

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। গতকাল দেশব্যাপী বিক্ষোভ করেছে হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী বেকার তরুণ-তরুণী। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ওপর রাতে হামলা চালায় পুলিশ। এতে আহত হন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার একপর্যায়ে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় শাহবাগ মোড় ও আশপাশের এলাকা। গতকাল রাত দেড়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার খবর পাওয়া যায়।
এদিকে রাত দেড়টায় আবু বকর নামে আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর গুজবে ঢাবির পাঁচটি হলের ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসেন। পরে ওই ছাত্র ফেসবুকে তার মৃত্যুর বিষয়টি নাকচ করে দেন।
হামলায় আহতদের মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সাধারণ পথচারী ও পুলিশও রয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজন গুরুতর জখমের শিকার হন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, রাতে আহত ৩৪ জনকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিকের বাম চোখ জখম হয়। রফিক নামে ঢাবির আরো এক শিক্ষার্থী ডান চোখে আঘাত পান। রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায় আন্দোলনকারী মো: আকরামের বাম হাতের আঙুল ভেঙে গেছে। ব্যারিস্টার আওলাদ হোসেন নামে এক পথচারী পায়ে গুরুতর জখম হন।

কোটা সংস্কারের আন্দোলনের দাবিতে গতকাল রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে জড়ো হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। বিকেল ৩টা থেকে তাদের অবস্থানের ফলে বন্ধ হয়ে যায় এ এলাকার যানবাহন চলাচল। এর প্রভাবে ঢাকার বিরাট অংশজুড়ে অচলাবস্থা নেমে আসে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যার পরও রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এর একপর্যায়ে রাত ৮টায় শত শত পুলিশ টিয়ার শেল, ফাঁকা গুলি, জলকামান ও লাঠিপেটার মাধ্যমে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। পুলিশের মারমুখী আক্রমণের ফলে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, কাঁটাবনের দিকের রাস্তা, বাংলামটর, মৎস্যভবনসহ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন। পুলিশের ধাওয়ায় আহত হন অনেকে। এ সময় অনেক ছাত্রছাত্রী অবস্থান নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাবি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির চত্বর, টিএসসির আশপাশে। তখনো পুলিশ তাদের ধাওয়া করে হামলা করে। টিএসসির আশপাশে আশ্রয় নেয়া অনেক শিক্ষার্থী এ সময় কেন্দ্রীয় ও ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
শাহবাগ মোড়ে পুলিশের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আশ্রয় নেয়া শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে রাতে ক্যাম্পাসে মিছিল করেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা।
পুলিশের হামলায় আহত হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিকও। গ্রেফতার করা হয়েছে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে।

আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের মারমুখী অবস্থানের কারণে শাহবাগ ও আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় সাধারণ পথচারীদের।
এ দিকে ধাওয়া খেয়ে টিএসসির দিকে ছুটে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। পুলিশের ধাওয়ায় আন্দোলনকারীরা ঢাবি ক্যাম্পাসের দিকে ঢুকে পড়ে চারুকলার সামনে অবস্থান নিয়ে সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিােভ শুরু করেন। তখন পাবলিক লাইব্রেরির সামনে অবস্থান নিয়ে থেমে থেমে তাদের ল্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছিল পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশ এগিয়ে এসে ফাঁকা গুলিও ছোড়ে। পুলিশের আক্রমণে পিছু হটে আন্দোলনকারীরা টিএসসির দিকে সরে এলে তাদের ওপর চড়াও হন ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। ভিডিও ধারণের সময় এক সাংবাদিকের মোবাইল ফোন ভেঙে দেন মতাসীন দল সমর্থিত সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স, কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়, প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু।

গতকাল বেলা ৩টায় পূর্বঘোষিত পদযাত্রা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। অবরোধের ফলে শাহবাগ থেকে মতিঝিল, ফার্মগেট, নিউ মার্কেট, দোয়েল চত্বর, সায়েন্সল্যাবমুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা শাহবাগে অবস্থান নেয়ার পর থেকেই বিপুল পুলিশও সেখানে অবস্থান নিতে থাকে।
এর আগে বেলা ২টায় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা ঢাবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হন। কয়েক হাজার আন্দোলনকারী পদযাত্রা নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে নীলক্ষেত হয়ে শাহবাগে এসে অবস্থান নেন। পুলিশ তাদের কয়েক দফা সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন এবং তাদের ওপর হামলা হলেও তারা স্থান ত্যাগ করবেন না বলে জানান।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনত শিক্ষার্থীরা বিকেলে গণগ্রন্থাগারের সামনে আড়াআড়িভাবে তিনটি ডাবল ডেকার বাস রেখে সড়ক অবরোধ করেন। এ ছাড়া আরো পাঁচ-সাতটি বাস দিয়ে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, নিউ মার্কেট ও মতিঝিলের দিকে চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেন তারা। তবে অসুস্থ নাগরিকদের চলাচলে কোনো ধরনের বাধা দিতে দেখা যায়নি বরং রোগী বহনকারী যানবাহনকে আন্দোলনস্থলের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন তারা।
আন্দোলন চলাকালীন বিভিন্ন ধরনের প্লাকার্ড বহন করেন তারা। এতে লেখা ছিল ‘১০ শতাংশের বেশি কোটা নয়’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় কোটা বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বৈষম্য থাকবে না’, ‘জেগেছে তরুণ জেগেছে দেশ, কোটা মুক্ত বাংলাদেশ’, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’ ইত্যাদি।
এ দিকে সংসদে কোটা সংস্কারের বিষয়ে একটি দিকনির্দেশনা আসুকÑ এমন প্রত্যাশা করে আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন জানান, দশম জাতীয় সংসদের অধিবেশন থেকে কোটাপদ্ধতির সংস্কার নিয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তারা অহিংস আন্দোলন-অবরোধ চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তারা সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। কোটা কত শতাংশ রাখা যায় তা বিবেচনার জন্য তারা একটা কমিশন গঠন করবেন। এটাই আমাদের মূল দাবি। সংসদ থেকে আশ^াস না পাওয়া পর্যন্ত তারা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, অবিলম্বে সরকারি চাকরিসহ সব ধরনের চাকরিতে কোটা প্রথার সংস্কার করতে হবে। সংস্কার ছাড়া আন্দোলনকারীরা রাজপথ ছাড়বেন না।

ঘটনাস্থলে নানক : রাতে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি আন্দোলনকারীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান এবং আজ বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান।

আজ ছাত্রধর্মঘট : এ দিকে ছাত্রদের ওপর দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশি হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা আজ সারা দেশে ছাত্রধর্মঘট ডেকেছেন। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আজকের সব কাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
ভিসির বাসভবন ভাঙচুর : রাত ১টার পর আন্দোলনকারী ছাত্ররা ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর করে এবং নিচ তলায় আসবাবপত্র বাইরে বের করে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় ভিসি তার বাসভবনেই ছিলেন। পরে পরিবারের সদস্যসহ তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

ছাত্রীরাও আন্দোলনে : রাতে ঢাবির ৫টি ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরা হল থেকে বের হয়ে এসে টিএসসিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে যোগ দেন। রাত সোয়া ২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ছাত্রছাত্রী টিএসসিতে অবস্থান করছিলেন। তারা সাংবাদিকদের জানান, তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা ফিরে যাবেন না।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/308805