রূপনগর খাল ভরাট করে রাস্তা তৈরি করছে ডিএনসিসি
৮ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ১০:১৭

রাজধানীতে খাল দখল

রক্ষকরাই ভক্ষক রূপনগর খালের

রূপনগর আবাসিক এলাকার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে যে এলাকাটা বোটানিক্যাল গার্ডেনের গায়ে গিয়ে লেগেছে, সেখানে দাঁড়ালে বোঝা যায়, একদা এখানে বেশ বড় একটি জলাধার ছিল। এখনও আছে জলাধারটি এবং কথা রয়েছে এখান থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়ার একটি সেতুও করা হবে। রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৩ নম্বর সড়কের ওই মাথায় দাঁড়ালে দেখা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে খালপাড় ধরে। খাল ভরাট করে একটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। জানা গেল, রাস্তাটি নির্মাণ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। নির্মীয়মাণ রাস্তার মাথাতেই আছে ওয়াসার একটি পানির পাম্প। ওই এলাকায় দুই দশক ধরে আছেন, এমন এক ব্যক্তি জানালেন, পাম্পের কাছে এসে খালটির এক মাথা বন্ধ হয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এই এলাকায় খালের জমিতে প্লট তৈরি করে বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।

ওয়াসার পানির পাম্প লাগোয়া পশ্চিমেও রয়েছে ছোটখাটো একটা বস্তি। বস্তির গাঘেঁষেই টানানো আছে একটি সাইন বোর্ড, যাতে লেখা রয়েছে, 'এই জমির মালিক হাজী জয়নাল উদ্দিন মাস্টার ও হাজী আবদুল মজিদ খান।' সাইন বোর্ড অনুযায়ী এটি দিগুণ মৌজা এবং ওই মৌজার ২৬০ শতাংশ জমির মালিক তারা দুইজন। রূপনগর খালের আরও কিছু জায়গায় এমন সাইন বোর্ড দেখা গেল।

এই যখন অবস্থা তখন ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরতুল্লাহ বলছেন, সিএস, আরএস ও এসএ দাগে রূপনগর খাল বলে কোনো খালই নেই। তিনি বলেন, তার ধারণা সেখানে পানি প্রবাহিত হতে হতে একটি নালা তৈরি হয়েছিল, সেটাকেই হয়তো রূপনগর খাল বলে। রূপনগর খালের পাশের যে রাস্তাটির জন্য সিটি করপোরেশনকে খাল ভরাটের দোষে অভিযুক্ত করা হচ্ছে সেই রাস্তার কাজও আপাতত বন্ধ আছে। কারণ, ওয়াসা, ভূমি অফিস, ডিসি অফিস ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে তারা চিঠি দিয়ে খালের সীমানা চিহ্নিত করে দিতে বলেছেন। সেটা ফয়সালা না হওয়ায় রাস্তার কাজ বন্ধ রেখেছেন। তবে ওই রাস্তার ভেতরে খালের কোনো জায়গা নেই দাবি করে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন কখনও খালের মধ্যে যাবে না। খাল ভরাট করবে না। তিনি জানান, খালের পাড় দিয়ে এক লেনের একটি রাস্তা হবে এবং এমন একটি রাস্তা হোক, সেটা এলাকাবাসীরও দাবি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রূপনগর আবাসিক এলাকার পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রূপনগর খালটির শুরু মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের কাছ থেকে। শেষ হয়েছে দিগুণ খালের সঙ্গে মিশে। রূপনগর আবাসিক এলাকার চা-দোকানি মো. সাহাবউদ্দিন জানালেন, এ খালটিকেও এক সময় দিগুণ খাল বলা হতো। রূপনগর আবাসিক এলাকা হওয়ার পর এটির নাম হয়েছে রূপনগর খাল। খালের পূর্ব পাশে রূপনগর আবাসিক এলাকা এবং পশ্চিম পাশে বিসিআইসি। সাহাবউদ্দিন যখন এ এলাকায় আসেন তখনও বিসিআইসির ভেতরে বেশ প্রশস্ত খাল ছিল। অবশ্য বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) বলছে, তারা দেয়াল দিয়ে নিজেদের জায়গা সংরক্ষণ করেছে। তাদের দাবি, এ দেয়াল আশির দশকে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের দেয়ালের ভেতরে খালের কোনো জমি নেই।

উত্তর সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবাশ্বের হোসেন চৌধুরী বলেন, যেখানে খাল ছিল সেই জায়গা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের। ২০০৭ সালে তারা ওয়াসাকে খালটি হস্তান্তর করার সময় বলেছিল ২০ ফুট খালসহ মোট ৬০ ফুট রাস্তা এখানে থাকবে। এর পরই সেখানে রাস্তাটি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওয়াসাকে একটি চিঠি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ২০ ফুট প্রশস্ত খাল পানি নিস্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত না। অন্তত ৩০ ফুট প্রশস্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি জানান, ওই খালের জায়গাতে ওয়াসা একটি পাম্পও বসিয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি ডিসি অফিস, সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ মিলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে আদালতে উপস্থাপনের জন্য। কারণ, এ ঘটনায় আদালতে একটি রিট মামলা হয়েছিল। এ জন্য রাস্তার কাজও বন্ধ।

রূপনগরের ৬ নম্বর থেকে ২৮ নম্বর সড়ক পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেল কয়েক জায়গায় খালপাড় সংরক্ষণের ব্লক পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। লালমাটির রাস্তাটির কোনো কোনো অংশে একেবারে খালের ভেতরে রয়েছে কিছু বস্তি ঘর। খালপাড়ে কিছু ভবনও যে খালের জায়গাতেই পড়েছে, তা খালি চোখে বুঝতে পারা যায়। এই খালটির মালিক জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খন্দকার আখতারুজ্জামান বলেন, 'খালটি ওয়াসাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তারাই দেখভাল করছে।' অবশ্য মিরপুর এলাকার দায়িত্ব পালনকারী জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান জানান, ১৯৮৬ সালে করা একটি মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। সেই নকশায় রূপনগর খালের পাড় দিয়ে ৪০ ফুট চওড়া একটি রাস্তা করার কথা। কিন্তু রাস্তাটি করা হয়নি। রূপনগর আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়ক থেকে ২৮ নম্বর সড়ক পর্যন্ত ওই রাস্তার জায়গা দখল করে অনেকেই ঘরবাড়ি ও বস্তিঘর তুলে রেখেছিল। সিটি করপোরেশন সেসব দখলদারকে তুলে দিয়ে রাস্তাটি করার উদ্যোগ নিয়েছে। রাস্তা করতে গিয়ে করপোরেশন খাল ভরাট করেছে কি-না তা তার জানা নেই। তবে খাল ভরাট করে প্লট বরাদ্দেরও কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, হয়তো খালের পাড়ে যেসব প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেই মালিকদের কেউ কেউ আগে বাড়ি করেননি। এখন যখন বাড়ি তৈরি করতে যাচ্ছেন, তখন এলাকাবাসী মনে করছেন নতুন করে খাল ভরাট করে প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, খাল রক্ষা করার কঠোর নির্দেশ রয়েছে, তাই ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষমতা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষেরও নেই।

রাজধানীর খাল দেখভালের দায়িত্ব পালনকারী ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী ফিরোজ আলম বলেন, রূপনগর খালের যাবতীয় চিত্র ও কাগজপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে খাল ভরাটের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। তবে তিনি বলেন, তারা খালটি রক্ষার জন্য চেষ্টা করছেন। খালপাড়ে পাম্প স্থাপন প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম বলেন, খালের প্রশস্ততা ঠিক রেখেই সেখানে পাম্পটি করা হয়েছে যাতে খালের কোনো ক্ষতি না হয়।

রূপনগর খাল আসলে দিগুণ খালেরই বিচ্ছিন্ন একটি অংশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) খাল নিয়ে এক গবেষণায় বলেছে, দিগুণ খাল প্রবাহিত হয়েছে মিরপুর-১, ২, ৬, ১১, ১২ নম্বর আবাসিক এলাকা, রূপনগর ও জাতীয় চিড়িয়াখানা এলাকার মধ্য দিয়ে। এই খালটি পড়েছে তুরাগে এবং খালটির বেশিরভাগ অংশ ময়লা ফেলে ও ছাপরা ঘর তুলে দখল করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকাও ওই খালের জমিতে গড়ে উঠেছে।

http://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/18041673