৮ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ৯:৫৩

শিক্ষায় নৈরাজ্য : বাড়ছে সামাজিক সঙ্কট

শামসুল হক (আসল নাম নয়) একজন সরকারি প্রকৌশলী। তার স্ত্রীও উচ্চশিক্ষিত ও বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। শামসুল হকের একান্ত বাসনা ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন। রাজধানীর নামকরা একটি কলেজ থেকে এইচএসসিতে ভালো রেজাল্টের পর মেডিক্যালে ভর্তির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন তার ছেলে। কিন্তু কোথাও চান্স হয়নি তার। শেষ পর্যন্ত শামসুল হক তার শাশুড়ির কাছ থেকে বিপুল টাকা ধার করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান ছেলেকে। কিন্তু দুই বছরের মাথায় শামসুল হক জানতে পারেন তার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না। পড়ালেখায় তার কোনো মন নেই। পরীক্ষায়ও অংশ নেয় না। যেসব পরীক্ষায় সে অংশ নিয়েছে তার বেশির ভাগে সে কৃতকার্য হয়নি। তার ছেলে বাসা থেকে তেমন একটা বের হয় না এখন।

ছেলের এ পরিণতিতে ভেঙে পড়েছেন শামসুল হক। ছেলের চেয়ে বেশি হতাশায় আক্রান্ত তিনি। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা তাকে সারাক্ষণ কুরে কুরে খাচ্ছে। কী করবেন দিশা করতে পারছেন না ।
এ সমাজে শামসুল হক একা নন। সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে নানামুখী সঙ্কট আর অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে অগণিত পরিবারকে। কেউ কেউ এসএসসি এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের পর চান্স পাচ্ছেন না ভালো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আবার জমিজমা বন্ধক রেখে লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করিয়েও ভালো কিছু করতে পারছে না অনেকে। কেউ বা টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশা বাদ দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ কোনো কলেজে।

এসএসসি এইচএসসি পাসের পর বাবা-মায়ের সব চেয়ে বড় চিন্তা এরপর কী হবে। কোথায় চান্স পাবে, কিভাবে চান্স পাবে। এ নিয়ে চলছে অভিভাবকদের মধ্যে নানামুখী অস্থিরতা আর হতাশা। কেউ বা বিড়ম্বনার শিকার হন মেডিক্যালসহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বিড়ম্বনায়। একজন অভিভাবক আক্ষেপ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি দেখেছেন কিভাবে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে মা-বাবা মেডিক্যাল, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন সংগ্রহ করে এবং সন্তানের ভর্তির ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, আমি দেখেছি আমার আশপাশের লোকজন সন্তানের ভর্তি পরীক্ষার আগে কিভাবে অসৎ হয়ে যান। কিভাবে পাগলের মতো ছোটাছুটি করেন প্রশ্ন সংগ্রহের জন্য। কিভাবে মেধাবীদের পেছনে ফেলে অনেকে অমেধাবীকে নামকরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে ফেলছে এবং বুক ফুলিয়ে তা প্রচারও করছে। আরো দেখেছি কিভাবে অনেক মেধাবী পরীক্ষার্থী আর তাদের মা-বাবারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকেন কিছু করতে না পেরে।

এ তো গেল উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রিক নানামুখী সঙ্কটের একটি দিক। প্রথম শ্রেণী থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে চলছে আরেক ধরনের সঙ্কট। সারা দেশের প্রায় সব শিক্ষার্থী এই সঙ্কটের ধকল পোহাচ্ছে। বিশেষ করে স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সন্তানের লেখাপড়া এখন সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মূলে রয়েছে ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া সমাপনী পরীক্ষা। সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে সমস্যা সঙ্কট শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবারে রূপ নিচ্ছে পারিবারিক বিরোধ। অনেক পরিবারে নিয়মিত ঝগড়া, দ্বন্দ্ব আর মনোমালিন্য লেগে আছে সন্তানের লেখাপড়া ঘিরে। সমাপনী পরীক্ষা, জেএসসি/জেডিসি, এসএসসি এইচএসসি ঘিরে হয়রানির শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থী আর তাদের মা-বাবা। এর ওপর রয়েছে সৃজনশীল আর প্রশ্নফাঁসের বিড়ম্বনা।
এক দিকে সন্তানের লেখাপড়ার চাপ সামলাতে নাভিশ্বাস অবস্থা অভিভাবকদের। উপরন্তু প্রশ্নফাঁসের কারণে মেধাবী শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকেরা একেবারেই হতাশায় ভেঙে পড়েন। কারণ সারা বছর হাজার হাজার টাকা খরচ আর অমানুষিক খাটুনির পর অনেকে তেমন পড়ালেখা না করে প্রশ্নফাঁস করে ভালো ফল করে। বিষয়টি তাদের জন্য সহ্য করার মতো নয়।
এ ছাড়া রয়েছে সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েও অনেক মা-বাবা এখন আর নিরাপদ বোধ করতে পারছেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ঘটছে নানা ধরনের অঘটন । শুধু তাই নয় ছেলে শিশুরাও এখন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ নয়। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মাদরাসায় ছেলে শিশু নিহতের ঘটনা ঘটেছে শিক্ষকের হাতে। এর পেছনে রয়েছে মানসিক বিকৃতি আর অধঃপাতের চিত্র।

এক দিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজ করছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি আরেক দিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন নীতি আর সিদ্ধান্তের কারণে সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে পরিবারগুলো রয়েছে নানামুখী চাপে। সবমিলিয়ে লেখাপড়া ঘিরে পারিবারিক সঙ্কট আর অস্থিরতা বেড়েছে। আর এ সঙ্কট প্রভাব ফেলছে বর্তমানে চলমান সামাজিক সঙ্কটের ক্ষেত্রে। শিক্ষাকেন্দ্রিক এ সমস্যা নতুন মাত্রা যোগ করেছে সামাজিক সঙ্কটে।
২০১৬ সালে রাজধানীর বনশ্রীতে এক মা হত্যা করেন তার দুই সন্তান অরনী (১২) ও আমানকে (৭)। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান, সন্তানদের পড়াশোনা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ রকমের উদ্বিগ্ন ছিলেন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানসিক দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতার কারণে তিনি তাদের হত্যা করেছেন ।

তার মেয়ে অরনী পড়ত ভিকারুননিসা নূন স্কুলে। ছেলে আমানও পড়ত নামকরা আরেকটি স্কুলে।
গত বছর এসএসসিতে জিপিএ ৫ না পাওয়ার পর রাজধানীতে আত্মহত্যা করে এক ছাত্র। এই ছাত্রের মা তার নাম পরিচয় গোপন রেখে ক্যামেরার সামনে তুলে ধরেন সন্তানের আত্মহত্যার কারণ। ভিডিও বার্তায় তিনি তুলে ধরেছেন কিভাবে দিনের পর দিন ভালো রেজাল্টের জন্য তার পরিবার তাদের সন্তানের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভালো রেজাল্ট করতে না পারায় এবং পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে না পারার চাপ ও মনোকষ্টে সন্তান পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয় রেজাল্ট প্রকাশের দিন।

ভিডিও বার্তায় ওই নারী সবার কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে বলেন, পরীক্ষা আর পড়া নিয়ে সন্তানের ওপর যেন তাদের মতো আর কেউ বাড়াবাড়ি না করেন।
সন্তানের পরীক্ষার রেজাল্ট এখন একটি সামাজিক মানসম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক মা-বাবার কাছে। সে কারণে অনেকে সন্তান নিয়ে লিপ্ত হচ্ছেন তীব্র সামাজিক প্রতিযোগিতায়। আর এর বলি হচ্ছে অবুঝ শিশুরা।

অনেক অভিভাবকই নির্দিধায় এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন, সন্তান ভালো রেজাল্ট না করলে আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর কাছে তাদের মুখ রক্ষা হবে না। সন্তানকে যে করেই হোক জিপিএ ৫ পেতেই হবে। সে কারণে ছোট ছোট সন্তানের ওপর যত ধরনের সম্ভব চাপ প্রয়োগ করা যায়, তা করছেন তারা। কিন্তু এ চাপ বহনের ক্ষমতা তাদের রয়েছে কি না সে মাত্রাজ্ঞান নেই অনেকেরই। শিশুরা তাদের সবচেয়ে আপনজন কর্তৃক শিকার হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/308532