৮ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ৯:৫২

পরীক্ষাকেন্দ্রে বসেই মেলে উত্তর!

বিস্ময়কর ডিজিটাল প্রতারণা; মাস্টার কার্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কানে পৌঁছে যায় উত্তর; জনপ্রতি নেয়া হয় তিন লাখ টাকা

দেখতে অবিকল ব্যাংকের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড; কিন্তু এ কার্ড দিয়ে ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তোলা যায় না। আসলে এটি ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড নয়, ওই কার্ডের প্রলেপ দেয়া একটি বিশেষ ইলেকট্রনিক ডিভাইস। এ ডিভাইসের ভেতরে থাকে মোবাইল সিম। এর মাধ্যমে বাইরে থেকে আসা কল রিসিভ করা গেলেও ওই ডিভাইস দিয়ে কল করা যায় না। ডিভাইসটির সাথে আছে একটি ছোট্ট বল্টুর মতো ইয়ারপিন, যা কানে লাগিয়ে ওই ডিভাইসে আসা কল রিসিভ করে কথা বলা যায়। আর এর মাধ্যমেই পরীক্ষার্থীর কানে পৌঁছে যায় প্রশ্নের সব উত্তর। এসব ডিভাইস ব্যবহার করেই বিসিএস, মেডিক্যাল, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ও সরকারি ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীকে পাস করিয়ে দেয় একটি জালিয়াত চক্র।
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া সরকারি ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ পরীক্ষায় এ রকম জালিয়াতি করে অনেককেই পাস করিয়েছে চক্রটি। এ চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের কিছু অসাধু ব্যক্তি, ইঞ্জিনিয়ার ও বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। গোয়েন্দাদের দাবি, এ চক্রটি একটি শক্তিশালী চক্র। ঢাকাকেন্দ্রিক এ চক্রের ১৫ জনকে শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা। এ ছাড়াও মাঠপর্যায়ে এ চক্রের শতাধিক সদস্য কাজ করছে। যারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে পরীক্ষায় পাস করতে চাওয়া প্রার্থীদের মোটা অঙ্কের বিনিময়ে চুক্তির মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করিয়ে থাকে। এ চক্রটির ঢাকার পান্থপথ ও নিউ মার্কেটে জালিয়াতির সার্ভিস সেন্টার রয়েছে। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা শুক্রবার হওয়ায় প্রতি বৃহস্পতিবার এ চক্রের সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের কাজ সেরে ঢাকায় ওই সেন্টারে অবস্থান নেয়। ওই সেন্টারগুলো থেকেই মূলত তাদের ক্লাইন্টদের সাথে যোগাযোগ ও প্রশ্নপত্র এবং উত্তরের আদান-প্রদান করে থাকে। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়েছে এসেছে, এ সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন ডিভাইস জালিয়াতির মাধ্যমেই সোনালী, পূবালী ও কৃষি ব্যাংকে চাকরি নিয়েছে।
বেশ কিছু দিন ধরেই একটি চক্র বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে আসছিল। বিষয়টি বেশি আলোচনায় আসে সম্প্রতি শেষ হওয়া এসএসসি এবং কয়েকটি সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার বেশির ভাগ প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর। এসব ঘটনা সামনে রেখে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরতে অভিযানে নামে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। কিছু দিন অনুসন্ধানের পর গোয়েন্দারা এই জালিয়াত চক্রের সন্ধান পান, যারা বিশেষ ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে মোবাইল সিমের মাধ্যমে পরীক্ষার সময় উত্তর সরবরাহ করে।

জানা গেছে, প্রথমে চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন পরীক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করে চুক্তি করত। চুক্তিকৃত অর্থের পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে আড়াই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত হতো। নির্দিষ্ট পরীক্ষার দিনে চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীদের বাহুতে বিশেষ কায়দায় মাস্টার কার্ড-সদৃশ ইলেকট্রনিক ডিভাইসটি স্থাপন করত। এরপর কানে লাগিয়ে দিত অতিক্ষুদ্র ইয়ারপিন, যার মাধ্যমে পরীক্ষার্থী কেবল কল রিসিভ করতে পারবে। কোনো কল দিতে পারবে না। পরীক্ষার্থী কেন্দ্রে ঢোকার পর বাইরে থেকে ডিভাইসটিতে ফোন করা হতো। পরীক্ষার্থী কৌশলে সেই কল রিসিভ করে প্রশ্ন জানিয়ে দেয় বাইরে থাকা এ চক্রের সদস্যদের। এরপর বাইরে থেকে ওই প্রশ্নের দ্রুত উত্তর বের করে ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হতো।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, চক্রের সদস্যরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিনটি কাজ করে থাকে। চক্রের কয়েকজন পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হতে আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করে। দ্বিতীয়ত, চক্রের আরেক অংশ পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার জন্য ডিভাইস ব্যবহার ও বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ করে। আরেকটি অংশ ডিভাইস সরবরাহে সহযোগিতা করে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/308542