গত শুক্রবার সংবাদ সংগ্রহের সময় আহত ফিলিস্তিনী সাংবাদিক ইয়াসির মুর্তজা গতকাল শনিবার মারা যান
৮ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ৯:৫০

ইসরাইলী তাণ্ডবে কিশোর-সাংবাদিকসহ ১০ ফিলিস্তিনীর শাহাদাতবরণ

হুমকি উপেক্ষা করে ভূমি দিবসের কর্মসূচির খবর সংগ্রহ গিয়ে ইসরায়লী সেনাবাহিনীর গুলীতে গাজা উপত্যকায় প্রাণ হারিয়েছে সাংবাদিকেরাও। এদিন ইসরায়লী গুলীতে শাহাদাতবরণ করেছে ফিলিস্তিনী। মারণাস্ত্রের বিপরীতে পাথর ছুঁড়ে প্রতিহত করতে গিয়ে আহত হয়েছে আরও সহস্রাধিক ফিলিস্তিনী। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুক্রবারের সংঘর্ষে সাত জনের মৃত্যুর খবর দিলেও ইসরাইলের সংবাদমাধ্যম হারেৎজের খবরে বলা হয়েছে সংঘর্ষের সময় আহত এক সাংবাদিকসহ অপর একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শনিবার নিহত হয়েছেন। এনিয়ে ভূমি দিবসের কর্মসূচিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯জনে। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যার ঘটনায় ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ভূমি দিবস উপলক্ষে ফিলিস্তিনীদের টানা ছয় সপ্তাহের বিক্ষোভের দ্বিতীয় পর্বে শুক্রবার দিন জোরালো বিক্ষোভের কর্মসূচি সফল করতে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয় ফিলিস্তিনীরা। ইসরায়েলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগদর লিবারম্যান বৃহস্পতিবারই গুলী ছোড়া অব্যাহত রাখার হুমকি দিয়ে রাখেন। এদিন তিনি বলেন, ফিলিস্তিনী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় পরিবর্তন আনার কোনও ইচ্ছে নেই। ইসরায়েলের সরকারি রেডিওতে তিনি বলেন, ‘ কোনও ধরনের উত্তেজনা দেখা গেলে গত সপ্তাহের মতো করেই কঠোরভাবে জবাব দেওয়া হবে।’ওই সপ্তাহে ইসরায়লী বাহিনীর গুলীতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৭ ফিলিস্তিনী।

হারেৎজের খবরে বলা হয়েছে, প্রেস লেখা জ্যাকেট পরে গাজা উপত্যকায় সংবাদ সংগ্রহের সময় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর গুলীতে আহত হন সাংবাদিক ইয়াসির মুর্তজা। গতকাল শনিবার হাসপাতালে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। ফিলিফিস্তিনী সাংবাদিক সিন্ডিকেটের তরফে বলা হয়েছে এদিন ইসরায়েলের গুলীতের আগত হয়েছেন আরও ছয় সাংবাদিক। তারা সবাই প্রেস লেখা জ্যাকেট পরে সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। ফিলিস্তিনী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা সীমান্তে এদিন ইসরায়েলের ছোঁড়া গুলীতে ২৯৩ জন গুলীবিদ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে ২৫ জনের শরীরের মাথা বা উপরের অংশে গুলীবিদ্ধ হয়েছে। আরও সহস্রাধিক মানুষ টিয়ার গ্যাস ও অন্য ছোটখাট আহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিহত নয় ফিলিস্তিনীর নাম প্রকাশ করেছে। তারা হলো ওসামা খামিস (৩৮), মাজদি সাবত, হুওসেইন মোহাম্মদ মাদি (১৬), সুবি আবু আতওয়াই (২০), মো. সায়িদ আল-হাজ (৩৩), সোদকি ফারাজ আবু আতওয়াই (৪৫), আলা আদিন আজমালি (১৭)। এছাড়া শনিবার নিহত হয়েছেন হামজা আবদ আল-আল (২০) ও সাংবাদিক ইয়াসির মুর্তজা (৩০)। ফিলিফিস্তিনী সাংবাদিক সিন্ডিকেট জানিয়েছে, গাজা সীমান্ত বেড়া থেকে ৩৫০ মিটার দূরে প্রেস লেখা জ্যাকেট পরে খবর সংগ্রহের সময় গুলীবিদ্ধ হন মুর্তজা। ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের হত্যা ও নিপীড়নের নিন্দা জানিয়েছেন। এছাড়া তিনি জাতিসংঘে নিযুক্ত ফিলিস্তিনী দূত, আরব লীগ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফিলিস্তিনী প্রতিনিধিদের ইসরায়েলের চালানো সন্ত্রাস, ও নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র রনেন ম্যানালিস দাবি করেছেন, শুক্রবার গাজা সীমান্তের পাঁচটি স্থানে ২০ হাজার ফিলিস্তিনী বিক্ষোভকারী জড়ো হয়। এসব বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের সীমান্ত বেড়া লক্ষ্য করে পাথর ও ফায়ারবোমা ছুঁড়েছে। এই সেনা মুখপাত্রের দাবি অবৈধভাবে ইসরায়েলের ভূখন্ডে প্রবেশের বেশ কয়েকটি চেষ্টা তারা প্রতিহত করেছে।

শুক্রবারও গাজা সীমান্তের নিরাপত্তা বেড়ার পাঁচটি স্থানে বিক্ষোভের জন্য জড়ো হয় কয়েক হাজার ফিলিস্তিনী। এদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। এর মধ্যে পশ্চিম তীরের নাবলুস, আল-বিরেহ, রামাল্লাহ ও হেবরন এলাকায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ইসরাইলী সেনারা সরাসরি বিক্ষোভরত ফিলিস্তিনীদের লক্ষ্য করে গুলী করে। জবাবে বিক্ষোভে থেকে তাদের দিকে পাথর ও ককটেল ছোঁড়া হয় এবং টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ দেখানো হয়। ২৭ বছর বয়সী সাঈদ সামের নামের এক বিক্ষোভকারী আলজাজিরাকে বলেন, ‘ইসরাইল আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। বাড়ি, স্বাধীনতা এবং আমাদের ভবিষ্যত।’তিনি বলেন, ‘আমার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। বিক্ষোভে এসে যদিও মারাও যাই, আমি জানি আল্লাহ তাদের দেখে রাখবেন।’এদিকে, এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনিও গুতেরেস ইসরাইলকে বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে হতাহতের ঘটনা এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অবশ্যই বেসামরিক নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। উভয়পক্ষকে সংঘর্ষ থেকে বিরত থেকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে হবে। ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ারও আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। গাজার উম্মাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আবু আমির আগেই আশঙ্কা করেছিলেন, ইসরাইল ফিলিস্তিনীদেরকে মুক্তভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেবে না। আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ইসরাইল এ বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করবে।’

ফিলিস্তিনী ভূখ-ে ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর জন্য জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) সদস্য দেশগুলো সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে গত শুক্রবার বিকালে ন্যামের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দুদিনের সম্মেলন শেষে চূড়ান্ত ঘোষণায় এ আহ্বান জানানো হয়।

ঘোষণায় ইসরাইল অনুসৃত অবৈধ নীতি ও ইহুদি বসতি নির্মাণের নিন্দা এবং সমালোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও, ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড়, হত্যাযজ্ঞ, জেল-জুলুম এবং স্বাভাবিক জনজীবনে বাধা সৃষ্টির প্রতিবাদ জানানো হয়।
ন্যামের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলেছেন, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইহুদিবাদী ইসরাইল যেসব এলাকা দখল করেছে তা থেকে অবশ্যই তেল আবিবকে সরে যেতে হবে।
এছাড়াও, গত ৩০ মার্চ ফিলিস্তিনী ভূমি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিক্ষোভ-প্রতিবাদ ও অবস্থান কর্মসূচিতে ইহুদিবাদী সেনাদের হত্যাযজ্ঞেরও নিন্দা জানানো হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের অপরাধ তৎপরতা বন্ধের জন্য ন্যামের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তেল আবিবের প্রতি আহ্বান জানান।

 

http://www.dailysangram.com/post/325788