৮ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ৯:৪৬

রাস্তাজুড়ে ঝুলন্ত মৃত্যুদূত

হাসান হামিদ


রিকশা করে শিল্পকলা একাডেমি যাচ্ছিলাম। নয়াপল্টনে একটা গলির ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম, ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক তারের বিরাট জটলায় একটা গাড়ি আটকা পড়েছে। শুধু নয়াপল্টন বা মতিঝিল, মিরপুর নয়; এ দৃশ্য রাজধানীর প্রতিটি গলির। রাজধানীজুড়ে বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটিগুলোতে বিপজ্জনকভাবে তারের জট নয়, এ যেন মৃত্যুদূত ঝুলছে। কয়েক দিন আগে শান্তিনগরে এক যুবকের মৃত্যুর কথা শুনেছি, যিনি নিজের দোকানের সামনের এসব তার নিজেই সরাতে চেয়েছিলেন। ঢাকা শহরে প্রায় সব ফুটপাথ বা রাস্তায় নেমে এসেছে তারের লাইন। ঝুলে থাকা এসব তারের মাধ্যমেই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। জঞ্জালের মতো নষ্ট করছে ঢাকার সৌন্দর্যও। যদিও রাজধানীতে ইন্টারনেট আর কেবল টিভির তার মাটির নিচ দিয়ে সরবরাহের কথা; কিন্তু তা মানছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন সাধারণ পথচারীরা।

এবার দেখি ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে কী বলে আসছে অনেক দিন ধরে। তারা বলছে, রাজধানীর মতিঝিল, গুলশান, নিকেতন ও মহাখালীতে তারা শতভাগ ভূগর্ভস্থ ক্যাবল অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন। সড়কগুলো থেকে বিপজ্জনক তার অপসারণ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অভিযান চালালেও কয়েক দিন পরেই ফিরে আসে আগের রূপ। ফলে কার্যত ভোগান্তি কমে না। আবার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ সুবিধা না থাকায় তারা এভাবে যত্রতত্র তার ঝুলিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদের সংগঠন আইএসপিএবি বলছে, ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক বা এনটিটিএন হলো মাটির নিচ দিয়ে তারের সংযোগ ব্যবস্থা। উন্নত দেশগুলোর মতো ঢাকায় এনটিটিএন ব্যবস্থা চালু হলে ইন্টারনেট সচল রেখে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার নামিয়ে ভূগর্ভস্থ করা সম্ভব।
আমরাও যতদূর জানি, মতিঝিল, গুলশান, নিকেতন ও মহাখালী ওল্ড ডিওএইচএস এলাকার প্রতিটি ভবনে স্থাপন করা হয়েছে অপটিক্যাল ফাইবার। ভূগর্ভস্থ ক্যাবলের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়িতেই সংযোগ প্রদানের ব্যবস্থা করে তুলেছে এনটিটিএন। তার পরও এসব এলাকার সড়কগুলোতে এখনো কেন ঝুলছে তারের ঝুরি? বিদ্যুতের পিলারে পিলারে রয়েছে তারের জট। একই চিত্র রাজধানীর অন্য এলাকাগুলোরও। যদিও এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সড়কগুলো থেকে বিপজ্জনক তার অপসারণ করতে গত পাঁচ বছরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। কোনো কোনো সড়কে তার কেটে অপসারণ করার কয়েক দিন পরই ফিরে আসে আগের রূপ। বারবার সময় দেয়ার পরও বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ঝোলানো এই তারের জট সরানো যায়নি। এখনো রাজধানীর সড়কগুলোয় বিপজ্জনক অবস্থায় ঝুলছে স্যাটেলাইট ক্যাবল অপারেটরদের ডিশলাইন ও ইন্টারনেটের শত শত তার। তার ছিঁড়ে মাঝে মধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বলছে, তাদের দু’টি পৃথক কমিটি ঝুলন্ত তার অপসারণে কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সবার সাথেই কয়েক দফা বৈঠক করেছেন বিদ্যুৎমন্ত্রী ও সচিব। দেয়া হয়েছে দফায় দফায় আলটিমেটাম। ২০১০ সাল থেকেই বিদ্যুৎ বিভাগে ঢাকা মহানগরীর রাস্তার পাশে বিদ্যুতের খুঁটিতে ঝুলন্ত তার অপসারণ বিষয়ে বিভিন্ন সময় সভা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে ঝুলন্ত তার অপসারণ নিয়ে সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার এবং এসএমএসের মাধ্যমেও সচেতন করতে হবে এমন কথাও তারা বলে আসছেন। ওই সভাগুলোতে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি), স্যাটেলাইট ক্যাবল অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকেই বিদ্যুৎ পোল থেকে তার সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে দফায় দফায়। প্রায় প্রতিটি সভাতেই ঝুলন্ত তার কেটে অপসারণের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয় এবং পুনরায় তার না তোলার জন্যও নির্দেশনা দেয়া হয়। কয়েক দিন অপসারণ কমিটি তার কেটে চলে যায় এর কিছু দিন পর আবারো সড়কগুলো আগের রূপ ফিরে পায়।

পত্রিকা মারফত জেনেছি, ২০১০ সালে সরকার রাজধানীর সব ঝুলন্ত তার ও বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন মাটির নিচ দিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে সংশ্লিষ্টরা সময় নিয়েছে। কর্তৃপক্ষ সময় দিয়েছেও; কিন্তু তার আর সরেনি। ঝুলন্ত তার ঝুলেই আছে। নগরীর সব জায়গায় বিশেষ করে ইন্টারনেট ও ডিশের তার বিদ্যুতের খুঁটিতে ঝুলছে বিশৃঙ্খলভাবে। কিছু কিছু স্থানে তারের চাপে খুঁটি হেলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর আগেও ২০০৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ভূগর্ভস্থ কমন নেটওয়ার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশনস ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) গাইডলাইন অনুযায়ী, ফাইবার অ্যাট হোম এবং সামিট কমিউনিকেশন রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাজ শেষ করেছে; কিন্তু বেশির ভাগ এলাকায়ই ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাবল টিভি অপারেটররা অভিন্ন এই নেটওয়ার্কে যুক্ত না হয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ক্যাবল টেনেছেন। এই ক্যাবল অপসারণ করতে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল; কিন্তু এই তারের জঞ্জাল সরেনি। ওই সময়ে ভিআইপি সড়কে এই তারের জঞ্জাল অপসারণে অভিযানও চালানো হয়েছিল। আর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিটিআরসি। ফলে আবারো বিপজ্জনক তারের জঞ্জাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের বৈদ্যুতিক খুঁটি দখল করে ফেলছে।

তবে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ ওই কমন নেটওয়ার্কে ঢুকতে মাশুল বেশি ধরছে সংশ্লিষ্ট দুই কোম্পানি। যে কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা চিন্তা করে কোনো কোনো ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ওই নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছে। অন্য দিকে রাজধানীর রাস্তাগুলোতে যাদের তার সবচেয়ে বেশি সেই আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি ভবনে ভবনে ক্যাবল নিয়ে যেতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত ঝুলন্ত তার অপসারণ করা সম্ভব হবে না। যদিও ঝুলন্ত তার অপসারণবিষয়ক মনিটরিং কমিটি মতিঝিল, গুলশান, মহাখালী, বারিধারা, নিকেতনসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে এনটিটিএন প্রতিটি ভবনে ইতোমধ্যে ভূগর্ভস্থ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছে।
বিটিআরসি সূত্র জানায়, গত চার বছরে ঝুলন্ত তারের মাত্র ২০-৩০ শতাংশ ভূগর্ভে স্থানান্তরিত হয়েছে। বাকি ৭০-৮০ শতাংশ এখনো রাস্তায় ঝুলছে। শুধু তাই নয়, বড় রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটি থেকে ঝুলন্ত তার সরিয়ে নেয়ার বাধ্যবাধকতার কারণে আইএসপি এবং ক্যাবল টিভি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো গলিপথে আরো ঝুঁকিপূর্ণভাবে তার ঝুলিয়েছে। রাজধানীতে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রায় ৬০টি আইএসপি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সংযোগের প্রায় পুরোটাই বিদ্যুতের খুঁটিনির্ভর। সম্প্রতি সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান বেকায়দায় পড়েছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে বারবার ধরনা দিচ্ছে এখনই যাতে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয়। রাজধানীর ফকিরাপুল, মতিঝিল, মগবাজার, পল্টন, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কগুলোয় ভূগর্ভস্থ অভিন্ন ক্যাবল নেটওয়ার্কে যুক্ত না হয়ে তার টাঙানো হয়েছে রাস্তার বৈদ্যুতিক খুঁটিতে। অভিযোগ আছে, বিটিআরসি, বিদ্যুৎ বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার কারণেই ঝুলন্ত তার সরানোর কাজ বিলম্ব হচ্ছে।
আর কত দিন সংশ্লিষ্টদের অবহেলা থাকবে জানি না; তবে কিছু অপ্রত্যাশিত মৃত্যু, বাতাস ভারী করা কিছু করুণ আর্তনাদ কিংবা একটা তরতাজা নিরপরাধ লাশ আমাদের ভাবাবে, যাতনা দেবে। আমরা এর থেকে মুক্তি চাই এবং খুব তাড়াতাড়ি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/308448