৭ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ১০:০৫

পঙ্গু হাসপাতালে এত দালাল, তাড়াবে কে?

দালালের ভারে ডুবছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানটি। পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত এ প্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনায় হাত-পা ভাঙা, অঙ্গহানি ও স্পাইনাল কডে আঘাতসহ বিভিন্ন ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা দেয়া হয়। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত হাত-পা ভাঙাসহ বিভিন্ন ধরনের আঘাতপ্রাপ্ত রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন। এখানে চিকিৎসাসেবায় বড় বাধা দালাল। ভবঘুরে দালাল ছাড়াও হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারী দালালির সঙ্গে জড়িত। পঙ্গু হাসপাতাল ঘিরে একাধিক দালাল চক্র এখন বেপরোয়া।
তাই এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মানুষের একটি কমন প্রশ্ন, পঙ্গু হাসপাতালে এত দালাল তাড়াবে কে।

এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা প্রতিনিয়ত পড়ছেন দালালদের খপ্পরে। সর্বস্ব খোয়ানোর পাশাপাশি সারাজীবনের জন্য পঙ্গুও হচ্ছেন কেউ কেউ। অভিযানেও থামে না তৎপরতা। গত এক সপ্তাহ আগে বাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত ভোলার চুন্নু বেপারী থেঁতলানো পা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। আসতে না আসতেই পড়েন দালালদের খপ্পরে, যারা তাকে উন্নত চিকিৎসার কথা বলে নিয়ে যান পাশের বেসরকারি একটি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে অবহেলায় দুদিন থাকার পর গত ২৯শে মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল রোগীরা দালালদের টার্গেট। এমন পরিস্থিতিতে পুরা হাসপাতাল দালাল সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। কর্মচারীদের বেশির ভাগ বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকের দালাল। এখানে টাকা না দিলে এক্স রে করার সিরিয়াল পাওয়া যায় না। অনেকেই বাইরে থেকে করিয়ে আনেন বেশি টাকা দিয়ে। এক্স-রে খরচ ৫৫ টাকা হলেও সিরিয়াল এগিয়ে নিয়ে আসতে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। ১০৭ নম্বর কক্ষটি এক্স-রে বিভাগ। ৪ঠা এপ্রিল দুপুর ১২টায় এক্স-রে এক ও তিন নম্বর দরজার সামনে দেখা যায় প্রচণ্ড ভিড় ও বিশৃঙ্খলা। ইব্রাহিম নামের এক রোগী অভিযোগ করে বলেন, সকাল ১০টা থেকে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তার এক্স-রে হচ্ছে না। যারা অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছেন তাদেরটাই করা হচ্ছে । ৩২ বছর বয়সী আরেক রোগী হানিফ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার ডান পা ভেঙে গেছে। এই রোগীর স্বজনরা জানান, ১০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি এক্স-রে করাবো। লাইন দিতে হবে না। এখানের কর্মচারীরা টাকা না দিলে কাজ করে না বলে তারা অভিযোগ করেন। এই হাসপাতালে রোগীদের জন্যে ড্রেসিং একটি নিয়মিত বিষয়। রোগীরা জানিয়েছেন, ড্রেসিংয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এমআরআই, সিটিস্ক্যান, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদিতেও বাড়তি অর্থ না দিলে কাজ হয় না। আবার জরুরি বিভাগের রোগীদের কাছ থেকে প্যাথলজির রসিদ না দিয়ে বাড়তি অর্থ আদায়ের অভিযোগও করেন রোগীরা।
র্যা ব-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম মানবজমিনকে বলেন, প্রায়ই অভিযান চালিয়ে দালালদের সাজা দেয়া হয়। সম্প্রতি পঙ্গু হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ ভুয়া ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানো হয় রাজধানীর ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। অভিযানের সময় অপারেশন থিয়েটারে প্রচুর রক্ত দেখতে পাই। এসময়ে হাসান ও আনোয়ার নামে দুজনকে দুই বছরের সাজা দেয়া হয়। এছাড়া আর পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হয়। তিনি আরো জানান, সেদিন অভিযানে চুন্নু ছাড়াও আরও ২২ রোগীকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে রাতে চুন্নুর অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ঢামেকে হাসপাতালে করা হলেও তার প্রাণ রক্ষা হয়নি। তিনি জানান, গত এক বছরের পঙ্গু হাসপাতালে শতাধিক দালাল গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজন হাসপাতালটির কর্মচারী ছিলেন।

সূত্র জানায়, ১৫ থেকে ২০টি সিন্ডিকেটে ২ শতাধিক দালাল হাসপাতালের রোগী ও স্বজনদের কাছে নেতিবাচক নানাকথা বলে তাদের ভাগানোর চেষ্টা করে। ৮ থেকে ১০ জন দালাল একেকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তাদের অপতৎপরতা চালায়। রোগীর স্বজনদের এখানকার চিকিৎসা সম্পর্কে নেতিবাচক নানান কথা বলে ভীতসন্ত্রন্ত করে তোলে। একপর্যায়ে রোগীকে হাসপাতাল থেকে বাগিয়ে আশপাশের প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যায়। ওই রোগীর কাছ থেকে প্রাইভেট ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ যে টাকা আয় করে তার শতকরা ৩০ থেকে ৫০ ভাগ কমিশন তারা পায়। এ চক্রের সঙ্গে হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারী ও নার্সের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। আর এ কারণেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়েও দমাতে পারছে না দালাল চক্রকে। সূত্র জানায়, ওয়ার্ড মাস্টার সবুর, দৌলত ও নজরুল অনেক দালালদের সঙ্গে শখ্য বজায় রাখেন। তারা বহির্বিভাগ থেকে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট একটা চাঁদা তুলেন। একই পরিস্থিতি জরুরি বিভাগেও। দালাল চক্রে রয়েছে বাবু, শওকত, জাহিদ, নাহিদ, মজনু, হাজেরা, আল-আমীন, রেজাউল, শাহানা, মোকারম, আলী, রুবেল, বাশার, শহিদুল, জহির মামুন, কল্পনা ও মরজিনা। তাদের কেউ হাসপাতালের কোনো কর্মচারীর আত্মীয়, কেউ স্থানীয় প্রভাবশালীদের আশীর্বাদপুষ্ট, আবার কারও আছে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পরিচয়। ফলে হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা এদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পান না। আর এ সুবাদে রোগী ভাগাচ্ছে দালালরা।

শেরেবাংলানগর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে শতাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। বাসা-বাড়িতে নামে বেনামে গড়ে তোলা হয়েছে এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দালালদের কেউ কেউ কোনো কোনো ক্লিনিকের মালিক বনে গেছেন। আবার কারও কারও অংশীদারি আছে বিভিন্ন ক্লিনিকে। হাসপাতালের সূত্র জানায়, দালালদের সহযোগিতা নিয়েই ওই এলাকায় কতিপয় প্রভাবশালী হাসপাতাল ব্যবসা চালিয়ে আসছে। মূলত সরকারি হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে নেয়া রোগীই তাদের হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে যাচ্ছে। আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে দালালদের সুসম্পর্ক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল গনি মোল্লা মানবজমিনকে বলেন, গভীর রাতে হাসপাতালে দালালদের অনুপ্রবেশ ঘটে। এখন টুকটাক হয় এটা স্বীকার করি। গেটের বাইরে হতে পারে। শতভাগ মুক্ত করতে পেরেছি, এটা দাবি করছি না। তবে দালালদের তৎপরতা আগের চেয়ে কমেছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=112282