৭ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ৯:৫৮

ঢাকার যানজট নিরসন

ডিটিসিএ’র সক্ষমতা নেই

যোগ্য নেতৃত্ব ও লোকবল সংকট * শক্তিশালী করার বিকল্প নেই

ভয়াবহ যানজটে রাজধানী ঢাকা অচল ও গতিহীন হয়ে পড়ছে। যানজটে এখানে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। টাকার অঙ্কে বছরে এ ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি। ঢাকাসহ আশপাশের যানজট নিরসনে ‘ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ’ (ডিটিসিএ) গঠন করা হলেও কোনো কাজে আসছে না। লোকবল সংকট ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে যানজট নিরসনে ডিটিসিএ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সংস্থাটির সেই সক্ষমতাও নেই। আর ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায়ও যানজট প্রকট আকার ধারণ করছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বর্তমানে ঢাকায় পরিবহনের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় সাত কিলোমিটার। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালে পরিবহনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের গতিবেগের চেয়ে কম। মানুষের হাঁটার গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার। ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার ৭ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার যানজট নিরসনে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে ডিটিসিএ। ডিটিসিএ’র মহাপরিকল্পনা ‘রিভাইসড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে’ (আরএসটিপি) রয়েছে পাঁচটি ‘মাস র্যা পিড ট্রানজিট’ (এমআরটি), দুইটি ‘বাস র্যা পিড ট্রানজিট’ (বিআরটি), ৭৩ কিলোমিটার ইনার রিং রোড, ১০৮ কিলোমিটার মিডল রিং রোড, ১২৯ কিলোমিটার আউটার রিং রোড, আটটি রেডিয়াল সড়ক, ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে, ২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাব, ঢাকার চারপাশের জলপথ উন্নয়ন প্রকল্প। বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে প্রণীত এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে যানজট সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবরূপ পাবে না। এ অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক চলাচলের উপযোগী হবে।
এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ডিটিসিএ সক্ষম নয়। কারণ মাত্র ১২ জন লোকবল নিয়ে গঠিত ডিটিসিএ’র নির্বাহী প্রধান হলেন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন সরকারি কর্মকর্তা। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে পুলিশের এসপি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকলেও পোস্টিং নেই। এ কারণে তার অফিসে আসা-যাওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই। ডিটিসিএ সমন্বিত কর্তৃপক্ষ হলেও অন্য সংস্থার প্রতিনিধিরা এ সংস্থার সভায় উপস্থিত হন না।

এ প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, একটি মেগাসিটির ব্যবস্থাপনা করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। একটি সমস্যার সমাধান করতে গেলে ১০টি সমস্যা তৈরি হয়। তিনি বলেন, ডিটিসিএ’র পেশাদার লোকবল বাড়াতে হবে। তিনি আরও বলেন, ডিটিসিএ’র প্রধান নির্বাহী অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার হওয়ায় অন্য সংস্থার প্রধানরা তার কথায় আসতে বাধ্য নন। এ কারণে ডিটিসিএ’র সভাগুলোয় নিচের পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এতে সভায় কোনো সিদ্ধান্ত হয় না।

এ প্রসঙ্গে ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স বাংলাদেশের (বিআইপি) সভাপতি একেএম আবুল কালাম যুগান্তরকে বলেন, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের ৭ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য প্রণীত এসটিপি, আরএসটিপি অত্যন্ত চমৎকার পরিকল্পনা। কিন্তু এ পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। কারণ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো সক্ষমতা ডিটিসিএ’র নেই। ১২ জন কর্মকর্তা এবং কিছু কর্মচারী নিয়ে এ বৃহৎ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, এখন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে সরকার পরিকল্পনাবিদদের ওপর দায় চাপাবে। তখন বলবে, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থার এ করুণ হাল। অথচ সুন্দর মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। কিন্তু সরকার সেটা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করছে না। এটা কেন করছে না, সেটা আমার বোধগম্য নয়।

নগরবিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ডিটিসিএ’কে শক্তিশালী হতে না দেয়ার নানা কারণ রয়েছে। ঢাকা শহর ও আশপাশের গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠান এবং যানজট নিরসন করতে হলে সংস্থাটিকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য পরিবহন কোম্পানিগুলোকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কোম্পানিতে পরিণত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের আধুনিক শহরগুলোয় অত্যন্ত সুশৃঙ্খল সিস্টেম রয়েছে। ঢাকা শহরে সেটা কবে হবে, সেটা জানি না। নিকট ভবিষ্যতে এর কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ডিটিসিএ’র সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম সালেহ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে ডিটিসিএ’কে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজনীয় জনবল বাড়াতে হবে। প্রেষণে দেয়া জনবল দিয়ে ডিটিসিএ’কে শক্তিশালী করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ডিটিসিএ’র বেশ কিছু অর্জন রয়েছে। ২০ বছরে ডিটিসিএ’র বড় অর্জন হল স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) তৈরি করা। গুরুত্ব না বোঝার কারণে ২০০৬ সালে তৎকালীন সরকার ডিটিসিএ’র কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৭ সালে পুনরায় ডিটিসিএ বহাল করা হয়। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ডিটিসিএ’র গুরুত্ব বোঝাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছে।
ডিটিসিএ’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহম্মদ যুগান্তরকে বলেন, ডিটিসিএ গঠন ছিল সরকারের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। যানজট নিরসনে এ সংস্থার মাধ্যমে যেসব কাজ করতে চায় সেগুলো যৌক্তিক। এজন্য এ সংস্থার ক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে ৫০টি টেকনিক্যাল পদসহ ১৪২ জনবল নিয়োগের সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদন করেছে সরকার। নিয়োগবিধি তৈরি হলে বিদ্যমান জনবল সংকট কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারব। তবে এ প্রক্রিয়া শেষ করাও অনেক সময়ের ব্যাপার।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/35780