৭ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ৯:৫০

প্লাস্টিক চাল বাজারে?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী: ভেতো বাঙাল বলে আমাদের বিশ্বজোড়া নামডাক আছে। না, এতে লজ্জিত হবার কিছু নেই। ভাত খেলেই কেউ বুদ্ধিশুদ্ধিতে পিছিয়ে থাকেন এর কোনও প্রমাণ নেই। এশিয়ার কমবেশ সবাই প্রায় ভাতখোর। আজকাল অনেকে রুটি খাচ্ছেন। তবে ঠেকায় পড়ে। কেউ চাল কিনতে পারেন না তাই রুটি খান। কারণ গমের দাম চাল অপেক্ষা কিছুটা হলেও কম। এছাড়া যাদের ডায়েবিটিজ রোগ আছে তারা সুগার কমানোর জন্য ভাত কম খান।

উদ্বেগের খবর হচ্ছে, মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্লাস্টিক থেকে চাল উৎপন্ন হচ্ছে চীনে। সেই প্লাস্টিক চাল ঢাকাসহ দেশের খুচরো বাজারে ঢুকেছে। মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাটারিভোগ আর বাসমতীর মতো চেনা-পরিচিত নামেই এ নকল চাল বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। তাও প্রকাশ্যে।
শুনে বিস্মিত হবার কথা যে, প্লাস্টিকের এ চাল হাঁড়িতে ফুটছে। চমৎকার ভাতও হচ্ছে। কিন্তু বুঝবার উপায় নেই। আপনি যে চালের ভাত খেলেন তা আসল চালের, না কৃত্রিমভাবে প্লাস্টিকের তৈরি নকল চালের? এটা নিশ্চিত হওয়াও কিন্তু চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। হ্যাঁ, চেষ্টা করলে ধরা যাবে। তবে এজন্য কিছু কাঠখড় পোড়াতে হবে আমাদের।

আগে ভারত, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে এ চালের খোঁজ পাওয়া যায়। এবার এখানেও পাওয়া যাচ্ছে। কে বা কারা চীনের তৈরি প্লাস্টিকের চাল আমদানি করেছে তা এখনও জানা যায়নি। সম্প্রতি খোলবাজার থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে কাটারিভোগ নামে প্লাস্টিক চাল কিনে আনবার অভিজ্ঞতা ফেসবুকের পোস্টে ভিডিও’র মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লায়লা ফারজানা নামের এক গৃহকর্ত্রী।
রাজধানীর শান্তিনগর বাজার থেকে কাটারিভোগ নামে কিনে আনা চাল সম্পর্কে ভিডিওতে তিনি বলেন, দেখে বুঝবার উপায় নেই যে এটি কৃত্রিম চাল। প্লাস্টিকের এ কৃত্রিম চাল হাঁড়িতে ফোটালে যে ভাত হয় তাও দেখতে হুবহু স্বাভাবিক ভাতের মতোই। চুলোর পাশে শুকনো ভাতের মাড় দেখে তা হাতে নেবার পর নেড়েচেড়ে লায়লা ফারজানা বুঝতে পারেন, তার হাতে প্লাস্টিকের চাল ধরিয়ে দিয়েছে দোকানদার। ধরিয়ে দিয়েছে ঠিক বলা যায় না। হয়তো দোকানদার নিজেও জানে না এটা প্লাস্টিকের ফাক চাল। লায়লা ফারজানা ভিডিওতে বলেন, তাঁর রান্না করা ভাতের মার শুকিয়ে তা আস্ত পলিথিনে পরিণত হয়েছে।

এর আগে ভারত ও ভিয়েতনামের বাজারে প্লাস্টিকের চাল খুঁজে পাওয়া গেলেও রাজধানী ঢাকার বাজারেও যে প্লাস্টিকের চাল ঢুকেছে, এই প্রথম তার প্রমাণ পাওয়া গেল। তবে কোন প্রক্রিয়ায় চীন থেকে প্লাস্টিকের চাল বাংলাদেশের বাজারে ঢুকছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি এখনও।
উল্লেখ্য, প্লাস্টিক চালের ভাত সম্পর্কে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে বলেন, এ চালের ভাত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। প্লাস্টিকে থাকে ‘ফিলেইটস’ নামক উপাদান, যা হরমোন এবং প্রজনন ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক চালের ভাত খেলে পাকস্থলিতে তৈরি হতে পারে ক্ষত ও মারণব্যাধি ক্যানসার। ধ্বংস করে দিতে পারে মানবদেহের স্বাভাবিক পরিপাক প্রণালীও।
চাল প্লাস্টিকের কি না, তা যাচাই করবার কিছু টিপস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সেগুলো হলো:
১. একমুঠো চাল নিয়ে তাতে দেয়াশলাই বা গ্যাসলাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিন। যদি প্লাস্টিকের চাল হয়, তবে প্লাস্টিকপোড়া গন্ধ বেরুবে।

২. চাল সেদ্ধ করে একটি বোতলে পুরে দু’তিন দিন রেখে দিন। প্লাস্টিকের হলে ওই সেদ্ধ চালে ফাঙ্গাস আক্রমণ করবে না।
৩. চালে গরম তেল ঢালুন অথবা কড়াইয়ে তেল গরম করে কিছু চাল দিন। যদি প্লাস্টিকের হয় তাহলে চাল গলে যাবে।
৪. পানিভর্তি একটি বোতলের মধ্যে এক টেবিল চামচ চাল দিন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। যদি চাল পানির ওপর ভাসতে দেখা যায়, তবে সেটি প্লাস্টিকের চাল। আসল চাল হলে তা পানিতে ভাসবে না।
৫. সেদ্ধ করবার সময়ও ভুয়া চাল শনাক্ত করা যায়। চাল যদি প্লাস্টিকের হয়, তবে সেদ্ধ করবার সময় পাত্রের নিচে মোটা স্তর জমবে।

প্লাস্টিক চালের ভাত সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, এর ভাত নিয়মিত খেলে মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। হতে পারে ক্যানসার বা জন্মগত ত্রুটির কারণ। এমনকি ঘটতে পারে মৃত্যুও।
আমার ছোটছেলে কিছুদিন আগে হোটেল থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট আনে। খেতে গিয়ে দেখা গেল বিরিয়ানির রাইস বা ভাত অস্বাভাবিক লম্বাটে। প্রায় পৌনে এক ইঞ্চির মতো। বাসমতী চাল হলেও এতো লম্বাটে হবার কথা নয়। ভাতের দুই প্রান্তও স্বাভাবিক বা সুচালো মনে হলো না। আমার কাছে মনে হয়েছে নুডুলস কেটে বা ভেঙে রান্না করলে এর প্রান্ত যেমন হয়, ঠিক ওরকম। আবার ঢাকার সুপার মার্কেট থেকে ২৪০ টাকা কেজি দরে ভারত থেকে আমদানিকৃত বাসমতী চাল এনে পোলাও রান্না হলো বাসায়। কিন্তু চাল বা ভাতের সুঘ্রাণ নেই মোটেও। বেশ লম্বাটে। ভাতের দুই প্রান্তও হোটেল থেকে আনা নুডুলসকাটার মতো। আমার মনে হয়েছে এগুলো প্লাস্টিকের নকল চালই। মসল্লা ও গোসত দিয়ে পাকালে খেতে গিয়ে তেমন ফারাক করা মুশকিল। তবে এবার বাজার থেকে বাসমতী বা কাটারিভোগ চাল আনলে উল্লিখিত পরীক্ষা ব্যতীত রান্না করা যাবে না বলে নোটিশ জারি করা হয়েছে।
চীন এমন একটি দেশ যেখানে সবকিছুর নকল বা ডুপ্লিকেট পাওয়া যায়। আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র থেকে মোবাইল সেট, জুতো-স্যান্ডেল থেকে নেপকিন, টুথব্রাশ থেকে মূল্যবান প্রসাধনী সবকিছুর কপি মেলে চীনে। এখন বাংলাদেশের মূল্যবান চাল কাটারিভোগ, বাসমতীসহ আরও নানা ধরণের সুগন্ধি চালের নকল হচ্ছে দেশটিতে। আর সেই নকল চাল আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে বলে সোস্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। আর এমন নিখুঁত ডুপ্লিকেট কার বাপের সাধ্যি তা সহজে ধরতে পারে?

তবে আমাদের নামকরা চালের ব্র্যান্ড নকল করে প্লাস্টিক চালের বাজারজাতকরণ মারাত্মক এবং যারপরনাই নিন্দনীয়। নকল এ চালের ভাত খেয়ে মানবদেহের যেমন ভয়াবহ ক্ষতি হবে, তেমনই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সুখ্যাতিও বিনষ্ট হতে পারে। কাজেই এ বিষয়ে অবিলম্বে আমাদের সরকারের তরফ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

সরকার দেশের খোলাবাজারে প্লাস্টিক চালের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যাদি সংগ্রহ করে তা চীনকে অবহিত করে ব্যবস্থা নেবার আহ্বান জানাতে পারে। চীন পদক্ষেপ না নিলে আন্তর্জাতিক আদালতেও মামলা ঠুকে দেয়া যায়। চীন যেহেতু আমাদের বন্ধুদেশ, সেহেতু এমন পদক্ষেপ নেয়া বেশ কঠিন। এতে জটিলতা বাড়তে পারে। সরকার প্লাস্টিক চালের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে বিরোধী দল তথা বিএনপি জোট এটাকে একটা ইস্যু হিসেবে নিয়ে জোরদার আন্দোলন করতে পারে। তবে চীনের সঙ্গে বিএনপি’রও ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তাই বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর সরকার ও বিরোধী জোট উভয়ের পক্ষেই। যাই হোক, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্লাস্টিকের ফাক রাইস বিষয়ে কোন পক্ষ জোরালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় সেটাই হচ্ছে ফেক্টর।

http://www.dailysangram.com/post/325639