৬ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৯:১৮

ধর্ষকদের রুখতে হবে

মামলা থেকে খালাস পেয়েছে সাইফুল। এ কথা জানার পর ডাক্তার সোনিয়া জেমিন প্রীতি তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন :'আর কারও ঘরে কন্যাশিশু জন্ম না নিক, যত দিন এমন জালিম দেশে বুক ফুলিয়ে চলতে পারে।' এমন মর্মস্পর্শী অনুভূতি প্রকাশের কারণ আছে বৈকি! জালিম বলতে ডা. সোনিয়া বুঝিয়েছেন খালাসপ্রাপ্ত সেই সাইফুলকে- যে ২০১৬ সালের অক্টোবরে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মাত্র ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে! ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলে শিশুটির যৌনাঙ্গ!

এই শিশুটিকে চিকিৎসা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন ডা. সোনিয়া প্রীতি। বুধবার রাতে ফেসবুকে তিনি তুলে ধরেছেন দেড় বছর আগেকার সেই সময়ের কথা, যখন শিশুটিকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর ল্যাম্প হাসপাতাল থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানে তখন কর্মরত ছিলেন এই ডাক্তার। সেদিনের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ডা. সোনিয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, 'আল্লাহ! এর চেয়ে বীভৎস দৃশ্য পৃথিবীতে আর হয় না।' তিনি জানিয়েছেন, ইন্টার্নে তত দিনে পাথর হওয়ার বিদ্যা শিখে গেলেও এই দৃশ্য সহ্য করার সাহস তাকে সৃষ্টিকর্তা দেননি। ডা. সোনিয়ার বর্ণনায় শিশুটির অবস্থার কথা জেনে আঁতকে উঠতে হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হয়। অপরাধী নিস্কৃতি পেয়ে যাওয়ায় গভীর বেদনা আর তীব্র ক্ষোভে এই চিকিৎসক লিখেছেন, 'এ দেশে এই নিষ্পাপ শিশুর মতো এক দেবশিশুর যৌনাঙ্গ যতটা সহজে সবার অগোচরে কেটে ফেলেছিল সাইফুল, ততটা সহজেই আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে গেছে।'

ছয় বছরের এই শিশুটির মতো প্রতিনিয়ত অসংখ্য শিশুই ধর্ষিত হচ্ছে। ধর্ষণের পর হত্যা, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর আত্মহত্যার খবর এখন নিত্যদিনের। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, শিশু থেকে তরুণী-প্রৌঢ়া-প্রতিবন্ধীসহ সমাজের সব ক্ষেত্রের, সব বয়সের নারীই ধর্ষিত হচ্ছে। এসব ঘটনায় অধিকাংশ অভিযুক্তই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সাইফুলের মতো ধর্ষণকারীদের সাজা হয় না বলেই ধর্ষণ বাড়তে বাড়তে পরিণত হয়েছে সামাজিক ব্যাধিতে। এখনই ধর্ষকদের রুখতে হবে। এই সামাজিক ব্যাধি দূর করতে হবে। না হলে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে সমাজ-সভ্যতায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, সমাজে 'ধর্ষণ' এখন ব্যাধি হয়ে উঠেছে। ধর্ষণের জন্য কোনোভাবেই সুনির্দিষ্ট কারণকে দায়ী করা যায় না। এ রকম ঘৃণ্য একটি অপরাধ করে অপরাধী যখন আইনের ফাঁকে পার পেয়ে যায়, তখন এ নিয়ে কিছুই বলার থাকে না। তিনি বলেন, ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের মানসিকতা একটি বড় ব্যাপার। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। সমাজে এখনও ধর্ষণের জন্য নারীকে দোষারোপ করা হয়। নারী কেন একা বের হলো, নারীর পোশাক এমন কেন- এ রকম অনেক বিষয় সামনে এনে অপরাধকে হালকা করা হয়। সময় এসেছে ভিকটিমকে দায়ী না করে অপরাধীর শাস্তি দাবি করা। নারীকে দোষারোপ করার প্রবণতা বাদ দিয়ে অবশ্যই সম্মিলিতভাবে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবেই সম্ভব ধর্ষণ থেকে সমাজকে রক্ষা করা।

নারী ও শিশুর অধিকার আদায়ে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠনের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৩৬৩ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৪ জনকে। সংগঠনের নেতারা বলছেন, এ পরিসংখ্যান বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক থেকে সংগৃহীত। এর বাইরেও অনেক ঘটনা রয়েছে, যা জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হয়নি।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট ১৮৭ নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১৯ জনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেন দু'জন এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ২১ নারীকে। এ সময় যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২৭ নারী।

আসকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে ৮১৮ নারী ধর্ষিত হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৭ নারীকে। ঘটনার পর আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন। ২০১৬ সালে ৭২৪ নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় এবং আত্মহত্যা করেন আটজন।

এদিকে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, বছরের প্রথম তিন মাসেই সারাদেশে ১৭৬ শিশু ধর্ষিত হয়েছে। এর মধ্যে গণধর্ষণ করা হয়েছে ২০ শিশুকে আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৫ শিশুকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২১ শিশুকে। ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রতিবন্ধী শিশুরাও। গত তিন মাসে আট প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ফোরামের তথ্যানুযায়ী, আগের বছর ২০১৭ সালে মোট ৫৯৩ শিশু ধর্ষিত হয়। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ৭০ শিশু এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২২ শিশুকে। ২০১৬ সালে মোট ৪৪৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ৬৮ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২১ শিশুকে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস শহীদ বলেন, গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ১৭ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি হয়েছে। গাণিতিক হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ৫৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।

মানবাধিকারকর্মী ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, নিদ্র্বিধায় বলা যায়, বিচারহীনতাই ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ধর্ষণের মতো অপরাধ করেও ধর্ষকের যখন শাস্তি হয় না, বরং সমাজে সে মাথা উঁচু করে চলে, তখন অন্যরাও উৎসাহিত হয়। তাই এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সবার আগে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, যত ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, থানায় তার মাত্র ২০ ভাগের বেশি মামলা হয় না। শতকরা এক ভাগের বেশি শাস্তি হয় না। রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ কমবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশ অভিযোগ পাওয়ামাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। পুলিশের গাফিলতির কারণে ধর্ষণের মামলায় কোনো অভিযুক্ত পার পেয়ে গেলে ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তিনি। এদিকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, গত চার বছরে (২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) দেশে ১৭ হাজার ২৮৯টি নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ভিকটিমের সংখ্যা ১৭ হাজার ৩৮৯ জন। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৮৬১ নারী ও তিন হাজার ৫২৮টি শিশু।

চার বছরে তিন হাজার ৪৩০টি ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ হওয়ার তথ্য দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে জানান, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোতে ১৭ জনকে মৃত্যুদ, ৮০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ, ৫৭৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাসহ মোট ৬৭৩ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, শিশু ও নারী নির্যাতন না কমার কারণ মূলত বিচারহীনতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধী অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী হওয়া এবং স্থানীয় সালিশে এক ধরনের আপস-মীমাংসার প্রবণতা। বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে নারীকেই। দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ায় বাড়ছে ধর্ষণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

http://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/18041211