ভরাট করে দখল আর দূষণে নবগঙ্গা এমন বেহাল।
৬ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৯:১৭

২৩০ কিলোমিটারজুড়ে নবগঙ্গার দুঃখগাথা

চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা মোহনা থেকে শুরু, এরপর ঝিনাইদহ ও মাগুরা হয়ে নড়াইলের ওপর দিয়ে লোহাগড়ার শেষ প্রান্ত মহাজন বাজারে মধুমতী নদীতে মিশেছে নবগঙ্গা। মোট দৈর্ঘ্য ২৩০ কিলোমিটার। মাগুরা থেকে তৎপলীন নড়াইল জেলার বৃহৎ নলদী-পরগনায় মিঠাপুরের মধ্য দিয়ে গাঢ় নীল রঙের পানির নবগঙ্গা নদী প্রবাহিত। নলদী-লোহাগড়া হয়ে একমুখ মধুমতীর সঙ্গে, আরেক মুখ বড়দিয়া কালিয়া হয়ে চিত্রা নদীর সঙ্গে মিশে নবগঙ্গা একসময় এই অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার ছিল। কালের বিবর্তনে মধুমতী নদীর চরে মূলধারা লোহাগড়া ঈদগাহের পেছনে মরে গিয়ে গড়ে ওঠে বর্তমান লোহাগড়া বাজার। চর পড়া নবগঙ্গা নদী গতি পরিবর্তন করে বানকানা নদী ছুঁয়ে মল্লিকপুরের মধ্য দিয়ে খুলনার গাজিরহাটে চিত্রার সঙ্গে মিশেছে। এই নবগঙ্গা বর্তমানে সরকার ও প্রভাবশালীদের খামখেয়ালিতে বিলুপ্তির পথে।

পাকিস্তান আমলে ১৯৬৩ সালে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (জিকে) জন্য নদীর উৎস মুখে বাঁধ নির্মাণের ফলে পানির প্রবাহ কমে যায়। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের অন্য নদীগুলোর মতো নবগঙ্গাও মরে যেতে থাকে। নাব্যতা হারানোর ফলে নবগঙ্গায় নৌ যোগাযোগও প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে।
ইংরেজ আমলে ওয়ারেন্ট হেস্টিংসের রাজত্বকালে নবগঙ্গা নদীর পারে গড়ে ওঠে লক্ষ্মীপাশা। নদীর পারে নলদী পরগনা ছিল জেলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। সেখান থেকে খাজনা আদায় আর নড়াইলে রাজত্ব চালাতেন ইংরেজ বণিকরা। নদীপাড়ের টোনা, বড়দিয়া, মহাজন, দীঘলিয়া, এড়েন্দা, লক্ষ্মীপাশা, ব্রাহ্মণডাঙ্গা, নলদী, মিঠাপুর বন্দর বাণিজ্যের কারণে জমজমাট ছিল। কালের বিবর্তনে নাব্যতা হারিয়ে নবগঙ্গা আর পুরনো জৌলুস ধরে রাখতে পারেনি।

একসময় নবগঙ্গা দিয়ে স্ট্রিমার চলত। তখন কলকাতা থেকে স্টিমার নিয়ে বণিকরা খুলনা হয়ে নড়াইলে আসতেন পসরা নিয়ে। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। নবগঙ্গার জৌলুস হারানোর জন্য প্রাকৃতিক কারণ যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী মনুষ্য সৃষ্ট কারণ।
গত ৩৫ বছরে সরকারি নানা প্রকল্প, নদীতীরের মানুষের দখল-দূষণ ইত্যাদি কারণে স্রোতস্বিনী নবগঙ্গা সরু থেকে সরুতর হয়েছে। বর্তমানে মহাজন, লক্ষ্মীপাশা, নলদী, মিঠাপুর বাজার এলাকায় কিছুটা সচল থাকলেও কুন্দশী থেকে মহাজন পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার নবগঙ্গা শুকিয়ে পায়ে চলা সরু পথে পরিণত হয়েছে।
নবগঙ্গা নদীর লোহাগড়া বাজারের সেতুর পাশে চর বানিয়ে সরকারি বরাদ্দ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান। লোহাগড়া পৌর ভবন নির্মাণের জন্য নদীতে বালি ফেলে ভরাট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। লোহাগড়া বাজারের দুই পাড়ে টংঘর তুলে নদী দখল করে ব্যবসা করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। এ ছাড়া নদীর জায়গায় ঘর তুলে বসবাসও করছে অনেকে। নদীর বিভিন্ন স্থানে মরে যাওয়া অংশে গড়ে উঠেছে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প। এসব আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলার সময় বাধা দিলেও প্রভাবশালীদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি নবগঙ্গা পারের মানুষ। নদীর আরো কয়েকটি স্থানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে গুচ্ছগ্রাম। স্থানীয়রা নবগঙ্গা নদী বাঁচাতে চেষ্টা করলেও প্রভাবশালীদের দখলের কারণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে নবগঙ্গা।

অন্যদিকে নদীশাসনের নামে নির্মাণ করা হয়েছে অপরিকল্পিত সেতু। নদীর ওপর গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়িসহ কাঁচা-পাকা বিভিন্ন স্থাপনা। নদীর মাঝখান পর্যন্ত বাঁধ দিয়ে, ভরাট করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। ঘের বানিয়ে মাছ চাষ করছে অনেক প্রভাবশালী। এসব কারণে লোহাগড়া উপজেলা সদরের লক্ষ্মীপাশা থেকে দক্ষিণে মহাজন বাজার পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার নদী নালায় পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি নবগঙ্গা নদীর চরমল্লিকপুরে পাঁচ একর জায়গায় বিনোদনকেন্দ্র তৈরি করেছেন এক প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা সিরাজ আল মামুন। নদীর খাসজমি দখল করে আলাদাভাবে পার বেঁধে সেখানে বড় বড় পাঁচটি পুকুর কেটে বিশাল প্রকল্প গড়ে তুলেছেন তিনি। স্থানীয়রা ভয়ে কিছু বলছে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীর পারে সরকারিভাবে ভূমিহীনদের ইজারা দেওয়া জমি স্বল্পমূল্যে ক্রয় করেছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তার ভাই মাসুদুর রহমান। তাঁর দাবি, তিনি ব্যক্তি মালিকানার জমি ক্রয় করে বিনোদনকেন্দ্র তৈরি করছেন। কিছু জমি নদীপারের ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দ করার পর স্থানীয় মালিকদের কাছ থেকে চাপ দিয়ে ক্রয় করে নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, নদীপারের মল্লিকপুর মৌজার ৯টি দাগের পাঁচ একর জমির প্রায় দুই একর সরকারি খাসজমি, যা নদীরই অংশ। পার্কের মালিক পুলিশ কর্মকর্তা মিরাজ আল মামুন হলেও নির্মাণকাজ দেখাশোনা করছেন তাঁর ছোট ভাই মাসুদুর রহমান। তিনি জানান, তাঁরা তাঁদের ক্রয় করা এবং পৈতৃক জমিতে নির্মাণকাজ করছেন, কোনো অনৈতিক কাজ করছেন না।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমান বলেন, দুর্নীতিবাজ কিছু সরকারি কর্মকর্তা প্রভাব খাটিয়ে নদী দখল করে নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। এতে স্থায়ীভাবে নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। এসব আর উদ্ধার করা যাবে না। স্থানীয়রা ভয়ে কিছু বলছেও না।
নদীর জায়গা দখল করে পার্ক নির্মাণ করা নিয়ে স্থানীয়রা লোহাগড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) এম এম আরাফাত হোসেনকে জানালে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কিছু দিন কাজ বন্ধ রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক চাপ আছে। জানি না কতদূর কী করতে পারব।’
খননে গাফিলতি : ২০১০ সালের এপ্রিল-মে মাসে মধুমতী নদীর সংযোগস্থল লোহাগড়া উপজেলার মহাজন থেকে দীঘলিয়া পর্যন্ত ৮.৬৮ কিলোমিটার অংশ খনন করা হয়। এ জন্য বরাদ্দ ছিল দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আর্থিক সহায়তায় নদী খনন প্রকল্পটির তত্ত্বাবধান করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এসডিসি) এই কাজের দায়িত্ব পায়।

মৃতপ্রায় নবগঙ্গার নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২০১১-১২ অর্থবছরে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মল্লিকপুর থেকে মহাজন পর্যন্ত খনন করা হলেও তা কাজে আসেনি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। তাদের অভিযোগ, খননের নামে মূলত পুরো টাকাই লুটপাট করা হয়েছে। নদীর আকারভেদে ৬০ থেকে ৮০ ফুট প্রস্থ এবং গড়ে চার ফুট গভীরতায় খনন করার কথা থাকলেও কিছুই করা হয়নি। তেলকাড়া, কলাগাছি, মাইগ্রাম, চরদিঘলিয়া, চরকোটাকোল, ভাটপাড়া ও দিঘলিয়া এলাকায় কোনো খননকাজই হয়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নড়াইল জেলা সভাপতি খন্দকার শওকত হোসেন বলেন, নদীতে পানিপ্রবাহ না থাকলে খনন করে কোনো লাভ হবে না। বর্ষায় পলি পড়ে আবার তা ভরাট হবে। নদী আর খাল খনন এখন লোক দেখানো প্রকল্প হয়ে গেছে। পরিকল্পনা ছাড়াই ঠিকাদাররা এসব কাজ করেন। কাজের কাজ কিছুই হয় না।

কুন্দশী গ্রামের মত্স্যজীবী গণেশ ও লক্ষ্মীপাশা গ্রামের জিতেন বিশ্বাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই নবগঙ্গা নদী আমাদের রুটি-রুজির উৎস। মাছ শিকার করে সংসার চালাতাম। নদী মরে যাওয়ায় এখন আর মাছ শিকার করা যায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় জীবন জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে শত শত জেলের। ফলে অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।
আশ্রয়ণ ও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প : ২০১৪ সালের মে মাসে নড়াইলের লোহাগড়া পৌর এলাকায় ‘মঙ্গলহাটা’ গুচ্ছগ্রাম তৈরি করতে নবগঙ্গা নদী ভরাট করা হয়। নদীর মধ্যে গুচ্ছগ্রাম করতে গিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন তখনকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেবেকা খান। যিনি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন। তৎপলীন লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, লোহাগড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তহমিনা খাতুন জমিটিকে নবগঙ্গা নদীর মধ্যে ৪৪ ও ৬৯ দাগের জমি হিসেবে উল্লেখ করলেও জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হয়। ওই সময় এ নিয়ে পত্রিকায় খবর প্রকাশ, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের পরও নবগঙ্গা নদীর এক একর ৫৩ শতাংশ এলাকা ভরাট করে তৈরি করা হয় গুচ্ছগ্রাম। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাইগ্রাম, রায়গ্রাম ও পাংখারচর এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শিয়রবরে নদী ভরাট করে গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ও নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নদী বাঁচাতে দেশে নদী খনন করা হচ্ছে। বিশ্ববাসীও নদী বাঁচাতে তত্পর। অথচ লোহাগড়ায় অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশে নবগঙ্গা নদী ভরাট করে গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হচ্ছে। নবগঙ্গা বাঁচাতে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রয়োজন।

নড়াইল জেলা নদী বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এস এ মতিন বলেন, নদী না বাঁচলে নৌপথ বন্ধ হয়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মারাত্মক ক্ষতি হবে কৃষির। ধ্বংস হবে মত্স্য সম্পদ। একই সঙ্গে পরিবেশও বিপন্ন হবে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে নদী দখল হওয়া দুঃখজনক।
নবগঙ্গা নদী দখল বিষয়ে লোহাগড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বেশ কিছু কর্মসূচি আমাদের হাতে থাকে না। আমি নবগঙ্গা নদী দখলমুক্ত করতে দখলদারদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। দখলদাররা যত প্রভাবশালীই হোক সিএস রেকর্ডে থাকা নদীর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে কাউকে দখল করতে দেওয়া হবে না।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/04/06/622076