৬ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৯:১২

এমসিকিউ নিয়ে অন্ধকারে জেএসসি এসএসসি এইচএসসির শিক্ষার্থীরা

সমাপনীতে মান বণ্টন নিয়ে দুশ্চিন্তা

প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষায় এমসিকিউ থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে অষ্পষ্টতা দূর হয়েছে। তবে এখনো উদ্বেগ আতঙ্কে রয়েছেন জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি ও সমমানের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা।

গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় লাগাতার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর থেকেই সমাপনী পরীক্ষাসহ পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দেয়া হবে মর্মে বেশ কয়েকবার বলা হয় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। কিন্তু মার্চ মাস শেষ হয়ে গেলেও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না আসায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। কারণ আগামী নভেম্বরে থেকে শুরু হতে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। এরপর থেকে এসএসসিসহ অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষা শুরু হবে। বছরের তিন মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু সমাপনী পরীক্ষায় এমসিকিউ থাকা না থাকা বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না জানানোর কারণে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং স্কুলের শিক্ষকেরাও। যদিও অনেকের কাছে এটি স্পষ্ট ছিল যে এমসিকিউ আর থাকছে না। কিন্তু এমসিকিউ না থাকলেও পরীক্ষায় প্রশ্নের মানবণ্টন কেমন হবে, প্রশ্নের ধারা কেমন হবে তা এখনো স্পষ্ট না হওয়ায় পড়ালেখায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে সব ক্ষেত্রে। অনেক স্কুলে প্রাথমিকের সমাপনী শিক্ষার্থীদের মডেল টেস্ট গ্রহণ শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার এমসিকিউ বাতিলের ঘোষণার আগ পর্যন্ত মডেল টেস্ট প্রশ্নে অনেক স্কুলে এমসিকিউ পদ্ধতিতে প্রশ্ন করা হয়েছে।
সমাপনীতে এমসিকিউ বাতিল করা হলেও তার স্থলে প্রশ্নের মানবণ্টন বিষয়টি এখনো না জানানো নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।

অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বারবার এভাবে পরীক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আমাদের জন্য, শিশুদের জন্য শাস্তি ছাড়া আর কিছু নয়। সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে আমরা আর কত বিড়ম্বনা সইব। এমনিতেই পরীক্ষা আর পড়ালেখার চিন্তায় অস্থির। তারপর বারবার শুধু পরিবর্তন আর পরিবর্তন। এসব আর ভালো লাগে না। ছোট ছোট শিশুদের আর কত কষ্ট দেবো আমরা। পড়ালেখা যে কঠিন করা হয়েছে তারপর বছরের তিন মাস চলে গেছে কিন্তু আমরা তখনো জানতে পারিনি পরীক্ষার ধরন কেমন হবে। এত দিন পর এমসিকিউ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে; কিন্তু তার স্থলে প্রশ্ন কেমন হবে তা এখনো জানানো হয়নি।

অনেকে এমসিকিউ পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে থাকলেও এখনো মানবণ্টন না জানানোয় হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকে বলেছেন, এমসিকিউ পদ্ধতি শিশুদের জন্য বেশ সহজ ছিল। কঠিন পড়ালেখা আর চাপের মধ্যে এটির মাধ্যমে আমরা একটু স্বস্তি পেতাম। কিন্তু এখন সেটিও আবার তুলে দেয়া হলো।
অনেক অভিভাবক জানান, এমসিকিউ পদ্ধতি বাতিল হলেও তার পরিবর্তে যেন সহজ ব্যবস্থা রাখা হয়। এক শব্দে বা এক বাক্যে উত্তর লেখা যায় এমন প্রশ্ন থাকলে শিশুদের জন্য সহজ হবে। কারণ দিন দিন পড়ালেখা শুধু কঠিনই হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে যত নিয়ম চালু করা হচ্ছে তার খেসারত দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের। এটি ঠিক নয়।

আবার গণিতের কথা চিন্তা করেও অনেকে সন্তুষ্ট এমসিকিউ তুলে দেয়ার কারণে। অনেক অভিভাবক বলেন, গণিতের এমসিকিউ খুবই পীড়াদায়ক শিশুদের জন্য। একটা গণিতের সমস্যার সমাধান করতে চার-পাঁচ মিনিট লেগে যায়; কিন্তু সময় পায় মাত্র এক মিনিট। এটা কী করে সম্ভব? অনেক অভিভাবক বলেছেন, এমসিকিউ ধরনের যেন কিছু না থাকে গণিতে। গণিতের প্রশ্ন সহজ করা উচিত বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক। তারা বলেছেন বিভিন্ন বছরের প্রশ্ন দেখলে বুঝবেন ছোট শিশুদের জন্য কী কঠিন প্রশ্ন করা হয় গণিতে।
অন্য দিকে আগামী বছর এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের এমসিকিউ বাতিল করা হলে তাদের সামনে সময় রয়েছে এক বছর। যদিও তাদের প্রত্যেকের এক বছর এরই মধ্যে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং স্কুলের বিভিন্ন পরীক্ষায় তারা এ পদ্ধতিতেই অংশগ্রহণ করে আসছে। তাই অবিলম্বে তারা এমসিকিউ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায় রয়েছে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রাথমিক শিা একাডেমি (নেপ) এক আদেশ জারি করে জানায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এ বছর থেকে শতভাগ যোগ্যতাভিত্তিক বা সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হবে শিক্ষার্থীদের। আদেশে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের প্রাথমিক শিা সমাপনী পরীার প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর বিভাজন জাতীয় কর্মশালার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতি বিষয়ে শতভাগ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন হবে। নেপের জারি করা এ মানবণ্টনে বাংলা ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে ৫০ নম্বরের এমসিকিউ রাখা ছিল। কিন্তু গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেস কনফারেন্সে প্রশ্নপত্র ফাঁস বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, টিক মারাটা বন্ধ করে দেবো। ওখানেই সুবিধা বেশি। ওটা বন্ধ করে দেবো।
এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নেপের কাছে নতুন করে মানবণ্টন বিষয়ে নোটিশ জারি করার জন্য বলা হয়।

এ ছাড়া গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় লাগাতার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা বেশ কয়েকবার বলেছেন তারা আগামীতে এমসিকিউ তুলে দেয়ার কথা জোরালোভাবে বিবেচনা করছেন। বিদ্যমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব নয়। পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হবে।
তখন থেকেই আলোচনা শুরু হয় এমসিকিউ পদ্ধতি থাকছে না আর। এরপর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সবাই মোটামুটি নিশ্চিত হন এমসিকিউ তুলে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এমসিকিউ থাকা না থাকা এবং মানবণ্টন বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসায় সমস্যায় পড়েন শিক্ষার্থী অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষ।

১৯৯২ সালে এসএসসিতে এমসিকিউ পদ্ধতি চালুর পর থেকেই এ নিয়ে সারা দেশে বিতর্ক চলে দীর্ঘ দিন। বাংলাদেশে শিক্ষার মান ধসের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেন এ পদ্ধতিকে।
তবে সমাপনীর এমসিকিউ পদ্ধতি একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। অষ্টম শ্রেণী থেকে এইচএসসি পর্যন্ত এমসিকিউ পদ্ধতিতে ওএমআর ফরম পূরণ করতে হয় সঠিক উত্তরের জন্য। লেখার কোনো বিষয় তাতে ছিল না। চারটি উত্তরের মধ্য থেকে সঠিক উত্তরের নম্বর ফরমে পূরণ করতে হতো। অনেকটা টিক চিহ্ন মারার মতো। কিন্তু সমাপনী পরীক্ষায় এমসিকিউ অংশে চারটি উত্তর থেকে সঠিক উত্তরটি খাতায় লিখতে হতো।

পরীক্ষায় নকল উঠে গেলেও এমসিকিউ পদ্ধতির কারণে পরীক্ষার হলে ব্যাপক হারে অসদুপায় অবলম্বন ফিরে আসে। গ্রামের বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে নৈরাজ্যের ভিডিও পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা যেমন একে অন্যের উত্তর বিনিময়ের সুযোগ পায় তেমনি শিক্ষক কর্তৃকও উত্তর বলে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এমনকি বোর্ডে উত্তর লিখে দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। তা ছাড়া ঘটছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। অনেক পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা বা ২০ মিনিট আগে প্রশ্নপত্র খুলে এমসিকিউ অংশ শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের বলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

এসব কারণে শেষ পর্যন্ত বাতিল হচ্ছে এ পদ্ধতি। এমসিকিউ পদ্ধতি চালুর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মুখস্থ প্রবণতা কমিয়ে পুরো বই সম্পর্কে যাতে ধারণা লাভ করে এবং তা যাচাই করা। কিন্তু এসএসসিতে শুরুতেই ৫০০ প্রশ্নব্যাংক নির্দিষ্ট করে দেয়ায় শিক্ষার্থীরা বই পড়ার পরিবর্তে গাইড কিনে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করতে থাকে। তা ছাড়া এমসিকিউ চালুর পর মুখস্থ প্রবণতাও কমানো যায়নি। কারণ আগে লিখিত ১০০ নম্বরের যেমন পুরো বই পড়তে হতো এমসিকিউ পদ্ধতি চালুর পরও ৫০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার জন্যও আগের মতো বই পড়তে হতো শিক্ষার্থীদের।
তাই অনেকের মত এমসিকিউ একটি ভালো পদ্ধতি হলেও ভুল প্রয়োগ পদ্ধতি এবং পরীক্ষার হলের পরিবেশসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার কারণে এ থেকে সুফল পাওয়ার পরিবর্তে শিক্ষায় বিপর্যয় ডেকে আনে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/307946