বাদল আমার সঙ্গে কলেজে পড়েছে, পরে বিশ্ববিদ্যালয়েও। এখন অবসরে, অনেকটা টিভি দেখে ও সমমনা লোকদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটায়।
বাদল অবসরে গেছে আমার আগে। কারণ তাদের ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণের বয়স ছিল ৫৯ বছর আর আমার ক্ষেত্রে তা ছিল ৬৫ বছর। আমি অবশ্য এখনও কিছু কাজ করি। কাজ না থাকলে কাজ সৃষ্টি করে নিই।
কোনো কাজ অর্থপূর্ণ, আবার কোনো কাজ মোটেও অর্থপূর্ণ নয়। যা হোক, সবচেয়ে বড় কথা হল, কাজের মধ্যে থাকতে আমার ভালো লাগে। অন্তত দুশ্চিন্তাগুলো সহজে কাছে ঘেঁষতে পারে না।
বাদল টেলিফোনে একদিন আমাকে বলল, সতীর্থদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ আছে কিনা? আমি বললাম, না। তবে যতদূর জানি, ওদের কেউ কেউ দেশে ভালো আছে বলে শুনেছি। আবার কেউ কেউ সন্তানদের সঙ্গে বিদেশে থাকে। বাদল বলল, মনে হয় এই সেদিন আমরা একসঙ্গে লেখাপড়া করলাম। তুমি ঢুকলে শিক্ষকতায় আর আমি গেলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এখন দু’জনেই অবসরে। মানুষ আমাদের বৃদ্ধ না বললেও বয়স্ক লোক বলে। কাজের মধ্যে থাকার কথা বলতে গিয়ে সে জানাল- তার পরিচিত কিছু বয়স্ক লোক আছেন, যারা শেয়ার ব্যবসা করেন। তারা যখন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন, তখন শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। তবে আমাকে দেখলে প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য বিষয়ে চলে যায়।
বাদলের ভাষ্য হচ্ছে- সে অর্থনীতি পড়েও শেয়ারবাজারটা বুঝতে চেষ্টা করল না, অথচ তার আশপাশের মানুষগুলো অর্থনীতি পড়েনি, অনেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েনি। তারপরও তারা শেয়ার ব্যবসা করছেন এবং ভালো করছেন বলেই মনে হয়।
তা না হলে এতদিন কিভাবে ওই ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন? ওর কথা শুনে আমি শুধু এটুকুই বললাম- কথিত শেয়ার ব্যবসা করতে খুব বেশি লেখাপড়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে বিনিয়োগকারী হতে গেলে অবশ্যই লেখাপড়া লাগে। ওকে বললাম- শেয়ার ব্যবসায়ী আর শেয়ারে বিনিয়োগকারী এক কথা নয়।
সফল বিনিয়োগকারী হতে গেলে অনেক কিছু জানতে হয়। এমন অনেক মানুষ অছে, যারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শেয়ার ব্যবসা করছে। তবে এক্ষেত্রে তারাও কিছু সূত্র অনুসরণ করে। তারা হল ‘উধু-ঃৎধফবৎং.’ প্রতিদিন কেনাবেচা করে। কখনও লাভ করে, কখনও লোকসান দেয়। তবে এদেরও লাভ করার বা জেতার একটি মৌসুম (ংবধংড়হ) থাকে। বাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী হয়, তখন ওরা খুব জিতে। বাজার যখন নিম্নমুখী হয়, তখন তাদের অধিকাংশই হারে বা লোকসানে পড়ে। আর বাজারে ধস নামলে এরা একেবারে ধরাশায়ী হয়ে যায়।
একদা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগের গুরু বলে পরিচিত বেঞ্জামিন গ্রাহাম ১৯৬৫ সালে ‘ঞযব ওহঃবষষরমবহঃ ওহাবংঃড়ৎ’ নামে একটি বই লিখেছিলেন, যে বইটি আজও স্টক মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের কাছে অতি সমাদৃত। গ্রাহামের পর স্টক মার্কেট বিনিয়োগ নিয়ে আরও শত শত বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গ্রাহামের সেই বইটি আজও এক নম্বর স্থান দখল করে আছে। গ্রাহামের বইটি হচ্ছে অতি মৌলিক; স্টক ইনভেস্টরদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। গ্রাহাম যখন বইটি লিখেছিলেন, তখন ‘ডে-ট্রেডারদের’ অত দৌরাত্ম্য ছিল না। পরে ওয়ালস্ট্রিটকে ঘিরে অনেক বিশেষজ্ঞ অনেক বই লিখেছেন এবং অনেকে সেসব বই পড়ে ভালোই উপকার পেয়েছেন। গ্রাহামকে অনুসরণ করেছেন বিশ্বের এক নম্বর সফল স্টক মার্কেট ইনভেস্টর ওয়ারেন বাফেট। বাফেট এবং তার অনুসারীরা আজও পুরনো তত্ত্ব ব্যবহার করে বিনিয়োগ করেন এবং তাদের সফলতা অন্যদের থেকে অনেক বেশি।
বাফেট কোনো স্টকের মৌল ভিত্তি বিশ্লেষণ করতেন এবং আজও করেন। তিনি বর্তমান অপেক্ষা স্টকের ভবিষ্যৎ বেশি দেখেন এবং শেষ পর্যন্ত বাফেটই জয়ী হন। আর অন্য দলের স্টক ইনভেস্টররা ছুটেন দলবদ্ধভাবে। তারা গতি বা ট্রেন্ডকে অনুসরণ করেন বেশি। এদের বলা হয় ঞবপযহরপধষ অহধষুংঃং. এরা কস্টশেয়ার কত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে, কারা কিনছে, শেয়ারটির আগের নিম্নতম মূল্য কত ছিল, এখন কত- এসব দেখে কোনো নির্দিষ্ট শেয়ারের পেছনে ছোটেন। তারাও সফল হন, তবে যতদিন আপ-ট্রেন্ডটা (টঢ়-ঃৎবহফ) বজায় থাকে। উড়হি-ঃৎবহফ শুরু হয়ে গেলে এদের অবস্থা সঙ্গিন হয়। এরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে শেয়ার কিনে অনেক দিন বসে থাকতে চান না। এরা মনে করেন, লাভ করতে হলে দুই-তিনদিন বা বড়জোর দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে করতে হবে। নইলে শেয়ার বেচে দিতে হবে। বাদল এদেরকেই শেয়ার ব্যবসায়ী বলে অভিহিত করেছিল। এরা ক্ষণে ক্ষণে আনন্দ যেমন পায়, তেমনি বেদনাও এদের আঘাত করে অতি কঠোরভাবে। আজ পর্যন্ত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সব হারিয়ে ফতুর হয়েছে, এমন শেয়ার ব্যবসায়ীর অধিকাংশই হচ্ছেন এ শ্রেণীর। এরাই অতি দ্রুত টার্নওভার সৃষ্টি করে, আবার সরবরাহের ক্ষেত্রেও তাই। এরা অনেক সময় অল্প মার্জিনে লাভ করে। তবে অনেক শেয়ার বেচাকেনা করে বলে মোট লাভ (আবার লোকসানও!) এদের বেশি হয়। এরাই হল মার্কেট মুভারস (গধৎশবঃ গড়াবৎং)। এদের মাধ্যমেই স্টক এক্সচেঞ্জের টার্নওভার গতি পায়। তাই এরা ব্রোকারদের কাছে অতি প্রিয়।
গ্রাহাম স্টক মার্কেটকে মি. মার্কেট (গৎ. গধৎশবঃ) বলেছেন। এই মি. মার্কেটের মতিগতি বোঝা বড়ই মুশকিল। লাখ লাখ মানুষ মি. মার্কেটে খেলছে। মি. মার্কেট কোনদিকে, কোথায় যাবে- কেউ বলতে পারে না। মি. মার্কেট কখনও কখনও অতি নির্দয় হয়। খুব জোরে আঘাত করে। তার আঘাতে অনেক শেয়ার ব্যবসায়ী নিঃস্ব হয়ে যায়।
তবুও তারা হাল ছাড়ার লোক নয়। তারা আবার আসে, আবার নতুন করে পুঁজি ঢালে। আশা- হয়তো তারা অতীতের লোকসান পুষিয়ে নিতে পারবে। এদেরকেই বলা হয় ঝঢ়বপঁষধঃড়ৎ বা কথিত ফটকাবাজ। এক ধরনের অতি লোভ এদের মধ্যে কাজ করে। এরা তাড়াতাড়ি ধনী হতে চায় বলে শেয়ার বাজারটাকে জুয়াখেলার বাক্স বানিয়ে ফেলে। কোনো কারণ নেই- এদের একদল একটা শেয়ার কিনছে, অন্য দল বেচছে। জিজ্ঞেস করলে ওরা বলে, এ শেয়ারের দর ওই পর্যন্ত যাবে। তাদের এ তথ্যের উৎস কী- জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারে না। এরা শুধু বিশ্বাস করে, ওই শেয়ারটার দর ওই সময় পর্যন্ত ওই পর্যন্ত যাবে। গুজবে এরা যেমন বিশ্বাস করে, তেমনি গুজব ছড়াতেও এরা ওস্তাদ। এদের মধ্যে অনেক দল-উপদল আছে। এরা একসঙ্গে চলে, দলছুট হয়ে কেউ কেউ লাভ করে লোকসান কমাতে সক্ষম হয়।
দলে নতুন সদস্য টানার ক্ষেত্রে এরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে। আর এদের জন্যই বাফেটের মৌল ভিত্তির বিশ্লেষণ কোনো কাজে আসে না। কারণ এরা ওই বিশ্লেষণের ধারেকাছে যেতে চায় না। কিন্তু সত্য হল, দীর্ঘমেয়াদে বাফেটরাই জিতেন। এক সপ্তাহে, এক মাসে, এক বছরে বাফেট হেরে যেতে পারেন। কিন্তু বিনিয়োগটা যখন পাঁচ বছরের জন্য হয়, তখন বাফেট জিতেন। সেজন্যই বাফেট বলতেন- ওই শেয়ারই আমি কিনি, যে শেয়ার বেচার জন্য আমি বাজার খুঁজি না। স্টক মার্কেট দশ বছর বন্ধ হয়ে থাকলেও আমার কোনো ক্ষতি নেই।
আমার এত কথা শোনার ধৈর্য বাদলের নেই। এমনকি এসব কথার অনেক কিছু সে বুঝবেও না। তাই সে টেলিফোন ছাড়তে চাইল। আমি বললাম, ঠিক আছে, এ ব্যাপারে তুমি বেশি মাথা ঘামাতে যেও না। দূরে আছো, দূরেই থাকো।
বাফেটদের জন্য আমাদের শেয়ারবাজার তেমন আকর্ষণীয় স্থান নয়। কারণ হল এ বাজারে মৌল ভিত্তির শেয়ারের সংখ্যা খুবই কম। ফলে এ বাজারে জুয়াড়ি বলুন, ফটকাবাজ বলুন, ভদ্র ভাষায় ডে-ট্রেডার্স বলুন- এদেরই আধিপত্য বেশি। কিন্তু বাজার যে বড়ই নিষ্ঠুর। গত চার মাস ধরে শেয়ারবাজার শুধু পড়ছে তো পড়ছেই, যা এ শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই খারাপ। কেন পড়ছে, সেটার বিশ্লেষণে না গিয়ে আবার বাজার ঘুরে দাঁড়াবে- এ আশায় তারা দুর্বল শেয়ারকে লাখ লাখ ইউনিটে কিনে লোকসান পোষাতে চাচ্ছে। কিন্তু মি. মার্কেট এবার বোধহয় একটু লম্বা সময়ের জন্যই মুখ গোমড়া করেছে। সহসা মুখ উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে তাদের অনেকে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ঢাকার শেয়ারবাজারে লেনদেন নেমে এসেছে আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে। বোঝা যাচ্ছে, মি. মার্কেট এবার অনেক বেশি নির্দয়!
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ