৬ এপ্রিল ২০১৮, শুক্রবার, ৯:০৪

মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা সংস্কার

শাহ্ আব্দুল হান্নান
বিশ বছর আগে ইসমাইল রাজী আল ফারুকীর Islamization of Knowledge বইটি পড়েছিলাম। এতে ছিল শিক্ষার ইসলামীকরণ সম্পর্কে আলোচনা। বইটি আবার পড়লাম কিছু দিন আগে।

ইসমাইল রাজী আল ফারুকী, আমার মতে, আল্লামা ইকবালের পর সবচেয়ে বড় ইসলামি দার্শনিক। তিনি ফিলিস্তিন, বৈরুত ও যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন। দর্শনে পিএইডি করেছিলেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি ইসলামি শিক্ষা-আন্দোলনের পরিকল্পনাকারীদের একজন। তার দশটির মতো বই এবং অনেক প্রবন্ধ রয়েছে। তার মধ্যে "Altauhid : Its Implications for Thought and Life" বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (BIIT) বাংলা অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে (রোড নং ২, বাড়ি নং-৪, সেক্টর-৯, উত্তরা, ঢাকা। ফোন : ০২-৫৮৯৫৪২৫৬)।
এ বইয়ের মূল কথাগুলো আমি এ প্রবন্ধে তুলে ধরছি। তিনি মনে করেন, মুসলিম বিশ্বের মূল সঙ্কট শিক্ষার ক্ষেত্রে। অন্যান্য সমস্যার পেছনে রয়েছে এ সমস্যা। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, উপনিবেশবাদীরা যে শিক্ষাব্যবস্থা রেখে যায় তার দর্শন, তার রূহ হচ্ছে পাশ্চাত্য চিন্তা। পাশ্চাত্য দর্শন মূলত বস্তুবাদী, সেকুলার, ভোগবাদী।

এসবই ইসলামের বিপরীত। এ শিক্ষার মাধ্যমে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন তারা ইসলামের কোনো জ্ঞান অর্জন করতে পারেন না; অন্য দিকে, বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে ইসলামবিরোধী দর্শন ও মূল্যবোধই শিখে থাকেন। এর ব্যতিক্রম শুধু তারা, যারা ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করে নেন। তারা ইসলামের কোনো কাজে লাগেন না। তারা পাশ্চাত্য সভ্যতার সৈনিক হন।

মুসলিম বিশ্ব স্বাধীন হওয়ার পর তাদের দায়িত্ব ছিল শিক্ষাকে ইসলামের আলোকে পুনর্গঠন করা। তিনি এ জন্য কয়েকটি প্রস্তাব দিচ্ছেন। প্রথমত, তিনি বলেছেন, পাশ্চাত্য জ্ঞানকে পুরোপুরি অধ্যয়ন করে যা নেয়ার মতো, তা নিতে হবে। অন্য দিকে ইসলামি জ্ঞানের পুরোপুরি অধ্যয়নের মাধ্যমে আজকের যুগে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কী কী সংযোজন করা দরকার, তা নির্ধারণ করতে হবে। এরপর সেগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে নতুন সিলেবাস ও পুস্তক রচনা করতে হবে। এ কাজ ইতোমধ্যে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। মালয়েশিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় (IIUM) এবং ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (IIIT), যুক্তরাষ্ট্র এবং BIIT বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে প্রায় বিশটি প্রধান সাবজেক্টের কারিকুলাম ও পুস্তক প্রণীত এবং প্রকাশিত হয়েছে। এ কাজ এগিয়ে চলছে।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে তেমন পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। তবে বিজ্ঞানে যেসব থিওরি ইসলামসম্মত নয় এবং বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত নয়, তার পুনর্বিবেচনা করতে হতে পারে। আমার মতে, বিজ্ঞানে যেখানে cause বা কারণ হিসেবে nature বা প্রকৃতির উল্লেখ করা হয়েছে, তার পরিবর্তে আল্লাহর আইন বা সুন্নাতুল্লাহ বা আল্লাহ উল্লেখ করার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ ছাড়া আল ফারুকী সব ছাত্রের জন্য একটি দুই বছরের ‘ইসলামি সভ্যতা কোর্র্স’ প্রবর্তনের কথা বলেছেন। এ কোর্সে থাকবে ইসলামের আগে বিশ্বের অবস্থা, সে সময়ের বিভিন্ন ধর্ম, মক্কার পরিবেশ। আরো থাকবে ইসলামের মূল শিক্ষা, মহানবী সা: ও তার সুন্নাহ, সাহাবাগণ, মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র, মুসলিম বিজয়গুলো, প্রশাসন ও ন্যায়বিচার। সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে থাকবে পরিবার, সমাজ ও জবাবদিহিতা, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে থাকবে কুরআন বিজ্ঞান (উলুমুল কুরআন), উলুমুল সুন্নাহ, উলুমুল ফিকাহ, উলুমুল আখলাক, নৈতিকতা ও আদব-কায়দা। এ ছাড়া নিচে উল্লেখিত বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত হবে, আধুনিক পাশ্চাত্য; সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ও কম্যুনিজম; ইহুদি ধর্ম ও জায়নবাদ; হিন্দু ধর্ম; বৌদ্ধ ধর্ম; চীনা ধর্ম ও সভ্যতা; জাপানি ধর্ম ও সভ্যতা; উপনিবেশবাদ ও তার ফলাফল; বিভিন্ন ইসলামি আন্দোলন; ব্যক্তিক ও পারিবারিক সমস্যা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার সমস্যা।

আমার মনে হয়, এ ধরনের কোর্স মালয়েশিয়ায় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে। এ ছাড়া এ বইয়ে মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অস্থিরতা, এ অস্থিরতার ফলাফল, অতীতে মুসলিম উম্মাহর ভুলÑ যেমন ইজতিহাদ ছেড়ে দেয়া, ওহির সাথে আকলের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি, ইসলামি দর্শনের নীতিমালা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ-এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এ বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেছেন সানাউল্লাহ আখুঞ্জী। এর প্রকাশক ইসলামিক ইনফরমেশন ব্যুরো (৩৬৯, উত্তর গোড়ান, ঢাকা)। আশা করি, এ আলোচনা থেকে সত্যিকার ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য পথ পাওয়া যাবে।
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/307890