সিঁড়িটি থাকলেও নেই বোয়ালিয়া খাল
৫ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০৭

পরিত্যক্ত সিঁড়িটি জানান দিচ্ছে খালের অস্তিত্ব

রাজধানীতে খাল দখল ২

আগে জানা না থাকলে বোঝাই যেত না যে, ওখানে একটি খাল আছে। অথচ খিলক্ষেতের বরুয়া এলাকায় পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের সেতুর নিচে বোয়ালিয়া নামের খালটি এখনও দেড়শ' ফুটের মতো প্রশস্ত রয়েছে। ওই সেতু থেকে পাঁচকানি রোড ধরে এগোতেই দেখা গেল টিনের বেড়ার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে খালটি। বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিয়ে টের পাওয়া যায় ওখানে খালটি এখনও সরু রেখার মতো নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর যেতেই বরুয়া বাজারের একটু আগে টিনের বেড়া গলিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারার মতো একটু ফাঁক পাওয়া গেল। ঢুকতেই নজরে এলো কয়েক ধাপের একটি সিঁড়ি নেমে গেছে খালে। তুরাগ থেকে উৎপন্ন হয়ে বালু নদীতে মিশে যাওয়া বোয়ালিয়া খালটি যে একদা প্রবহমান ছিল, লোকজন এই খালের পানিতে গোসল করতেও নামত, পরিত্যক্ত সিঁড়ির ধাপগুলো তারই জানান দিয়ে যাচ্ছে। যেখানটায় এই পরিত্যক্ত সিঁড়ির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল, তার ঠিক বিপরীতের বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক ইব্রাহিম খলিল জানালেন, বছর দশেক আগে চাকরিসূত্রে যখন এখানে আসেন, তখনও প্রশস্ত বোয়ালিয়া খালের এই অংশে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ছিল। এখানেই গোসল করতেন তিনি। বর্ষায় জেলেরা খালে মাছ ধরত।

পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্পের জন্য ভরাট করা হচ্ছে বোয়ালিয়া খালের এই এলাকাটি। অথচ খালের এই অংশটি ভরাট হয়ে গেলে রাজধানীর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে পাঁচ হাজার কোটি টাকার নতুন খাল খনন প্রকল্প অর্থহীন হয়ে পড়বে। পুলিশ কর্মকর্তাদের এই আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি। 'জলাধার আইন লঙ্ঘনের' অভিযোগ এনে খালটি ভরাট না করার জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) গত বছরের এপ্রিলে সমিতিকে চিঠি দেয়। খাল রক্ষায় সরাসরি না হলেও পুলিশের পরোক্ষ দায়িত্ব রয়েছে, বিশেষ করে দখল প্রতিরোধ ও উচ্ছেদে পুলিশের ভূমিকা বিশেষ প্রয়োজন। তাই খোদ পুলিশ কর্মকর্তাদের সমিতি যখন খাল দখলে নেমে পড়ে, তখন অসহায় হয়ে পড়ে রক্ষাকারী সংস্থাগুলো। রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমানসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান জানান, গত এপ্রিল মাসে চিঠি দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত বোয়ালিয়া খালের ভরাট হওয়া অংশ পুনরুদ্ধারে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কুড়িল-পূর্বাচল সড়কের দু'পাশে ১০০ ফুট প্রশস্তের নতুন যে খাল খনন করা হচ্ছে, সেই খালটিকে বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে যুক্ত করা না গেলে পাঁচ হাজার কোটি টাকার নতুন খাল উপচে দুই পাড় প্লাবিত হবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বোয়ালিয়া খাল ভরাট করায় এরই মধ্যে দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, কাওলা, গুলশান, বারিধারা, সেনানিবাস, নিকুঞ্জ, জোয়ার সাহারাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে। আসছে বর্ষায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ৩০০ ফুট সড়কের পাশে খনন করা ১০০ ফুট খাল প্রথমে বোয়ালিয়া খালের সঙ্গে মিলবে। পরে আবার বোয়ালিয়া খাল থেকে বালু নদ পর্যন্ত যাবে। এ কারণে বোয়ালিয়া খালটি প্রবহমান না থাকলে এই খাল খনন অর্থহীন হয়ে পড়বে। তিনি জানান, বোয়ালিয়া খালের সংযোগস্থলে স্লুইসগেট থাকবে পানি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এ ছাড়া বারিধারা, গুলশান, বাড্ডা, ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর, নিকুঞ্জ এলাকার প্রস্তাবিত স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্কের পাইপও বোয়ালিয়া খালের ওপর পড়বে। এ কারণেও ওই খালের প্রবাহ রক্ষা করতে হবে।

নুরুল ইসলাম আরও বলেন, খিলক্ষেত-ইছাপুরা সড়কের ওপর পুরনো বোয়ালিয়া সেতুর কাছে খালের প্রশস্ততা প্রায় ২০০ ফুট। সেখান থেকে উত্তর দিকে খালটি কোথাও ১৫০ ফুট, কোথাও এর চেয়ে বেশি চওড়া। বোয়ালিয়া খালের প্রশস্ততা এখনও কোথাও কোথাও বালু নদের চেয়ে বেশি। এমন একটি খালের প্রবাহ বন্ধ করা কোনোভাবেই উচিত হবে না।

জানা যায়, বোয়ালিয়া খালের উৎপত্তি উত্তরখান থানার তেমুখ এলাকার তুরাগ নদে। উৎপত্তিস্থল থেকে খালটি পোড়াদিয়া, ভাটারা ও বরুয়ার ভেতর দিয়ে বেরাইদের কাছে বালু নদে মিশেছে। একসময় খালটি তেমুখ থেকে বেরাইদ পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল। এখন তেমুখ থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার এবং বসুন্ধরার এম ব্লক থেকে বালু নদ পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটারের মতো খাল আছে। রাজউকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাঝের দেড় কিলোমিটার অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

খালের এই অংশ ভরাটের বিষয়টি রাজউক কর্মকর্তাদের নজরে আসে কুড়িল-পূর্বাচল সড়কের দু'পাশে নেওয়া '১০০ ফুট খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্প' এলাকা পরিদর্শনের সময়। নগর পরিকল্পনা শাখা থেকে দ্বিতীয় দফা পরিদর্শন ও জরিপে খাল ভরাটের প্রমাণ পান রাজউকের কর্মকর্তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম গত ১৭ এপ্রিল পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) ও পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির দপ্তর সম্পাদক গাজী মো. মোজাম্মেল হককে চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, "সরেজমিন জরিপে দেখা গেছে, কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোড সংলগ্ন 'পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি' আবাসন প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তরে বোয়ালিয়া খাল আপনার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভরাট করা হয়েছে, যা জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর পরিপন্থী।" চিঠিতে আরও বলা হয়, 'উক্ত এলাকাসহ খিলক্ষেত, লেকসিটি কনকর্ড এবং তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকার বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের জন্য বোয়ালিয়া খালের নিরবচ্ছিন্ন পানিপ্রবাহ অতীব জরুরি।' তাই চিঠিতে পুলিশের আবাসন প্রকল্প এলাকার ভেতরে 'প্রবহমান' বোয়ালিয়া খাল 'ভরাট বন্ধে' প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির দপ্তর সম্পাদক ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক গাজী মো. মোজাম্মেল হক বলেন, তারা খালের জায়গা ভরাট করেননি। রাজউক বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে পুলিশ খাল ভরাট করেছে। কিন্তু আরএস-সিএস ম্যাপে বোয়ালিয়া খাল কোথাও ২৫ ফুট, কোথাও ৩২ ফুট প্রশস্ত। একমাত্র খিলক্ষেত পয়েন্টে প্রশস্ততা ৪০ ফুট। অথচ রাজউক ড্যাপে সেটাকে ১৫০ ফুট হিসেবে উল্লেখ করছে। রাজউক যদি খালটিকে ১৫০ ফুট প্রশস্ত করতে চায়, তাহলে পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির কাছ থেকে বেশ খানিকটা জমি অধিগ্রহণ করে নিতে হবে। এ নিয়ে গত নভেম্বর মাসে রাজউকের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। রাজউক অধিগ্রহণে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো নোটিশ দেয়নি। নোটিশ দেওয়ার পর ১৫০ ফুট জায়গা ছেড়ে দেওয়া হবে। এ জন্য রাজউককে দুই একর ৩১ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। মোজাম্মেল হকের দাবি, রাজউক নিজেদের অদক্ষতা ঢাকতে পুলিশের নামে খাল ভরাটের অভিযোগ তুলছে।

রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, খাল ভরাটের বিষয়টি তো পুলিশ অফিসার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি স্বীকারই করছে না। তবু খালটির প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে এবং এ জন্য কী করা যায়, সেটা চিন্তা করছে রাজউক। কারণ খাল উদ্ধারের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।

http://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/18041024