৫ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০২

আগ্রাসী ব্যাংক প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে

ব্যাংকে টাকার সঙ্কট

আমানতের চেয়ে কম হারে বিনিয়োগ হওয়ার কথা। হচ্ছে উল্টো। আবার রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে আমদানির জন্য এলসি খোলা হচ্ছে তার প্রায় দ্বিগুণ। চাহিদার সাথে সরবরাহের পার্থক্য বেশি হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে টাকার বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আর এ সঙ্কট কাটাতে নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর সিআরআর কমানোর মতো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাজারে টাকার সঙ্কট হওয়ার পেছনে আগ্রাসী ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে বলে ওই সূত্র জানায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, কিছু কিছু ব্যাংক আগ্রাসী বিনিয়োগ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান না করেই বড় অঙ্কের এলসি খুলছে। কিন্তু এলসির দায় মেটানোর সময় তা আর পরিশোধ করতে পারছে না। বাজারে ডলার না পেয়ে হাত পাতছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে গতকাল বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৭৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। ডলার বিক্রি করে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এ অর্থ সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আটকা পড়েছে। ব্যাংকগুলোর এই আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে বাজারে সরাসরি দুই ধরনের প্রভাব পড়েছে। প্রথমত, টাকার চক্রবৃদ্ধি থেমে গেছে। সাধারণত অর্থনীতিতে এক টাকা পাঁচবার হাত বদল হয় যার সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ১৫ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়ায় প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। টাকার সঙ্কটের পেছনে এটি অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দেখছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। যেমন গত বছরের ৩০ জুনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল তিন হাজার ৩৪৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত ২৮ মার্চে তা তিন হাজার ২৩৯ কোটি ডলারে নেমে গেছে। জুনের পর গত ৯ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়েনি, বরং বাজারে ১৭৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। অথচ এ ডলার বিক্রি করতে না হলে রিজার্ভ সাড়ে তিন হাজার কোটি ডলার ছেড়ে যেতো।
আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঘাটতি থাকছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এমনিতেই এক মাস পিছিয়ে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ। যেমন, জানুয়ারি মাসে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। কিন্তু বিপরীতে ফেব্রুয়ারি মাসে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৩০৭ কোটি ডলার। আর রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১২০ কোটি ডলার। আমদানি ও রফতানি আয় হিসাব নিলে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার চেয়ে ঘাটতি থাকছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার। যদি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরবরাহ অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে প্রতি মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০০ কোটি ডলার কমে যাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে।

আবার যদি রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ না করা হয়, অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেয়, তাহলে প্রতি ডলারে ব্যয় ১০০ টাকা ছেড়ে যাবে। তখন আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে।
মুদ্রাবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধে জানুয়ারিতে ঋণ আমানতের অনুপাত ৮৫ শতাংশ থেকে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৩ দশমিক ৫ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ থেকে ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংকই আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধ করেনি, বরং বেশি হারে বিনিয়োগ করছে। যেমন, জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে হয় ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। যে হারে এলসি খোলা হচ্ছে সামনে এ হার আরো বেড়ে যাবে। গত জানুয়ারিতেও আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

প্রচলিত ধারায় আমানতের প্রবৃদ্ধির চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার কথা থাকলেও হচ্ছে উল্টো, যা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী যে পরিমাণ ঋণ দেয়া হচ্ছে তা উৎপাদনশীল খাতে যাচ্ছে না। ঋণের অর্থ হয় হন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে, না হয় গ্রাহক ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করছে। অর্থাৎ সঠিক কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে না। ঋণ সঠিক কাজে ব্যবহার না হওয়ায় আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। আর আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য কমে যাচ্ছে।
মাস ছয়েক আগেও যেখানে উদ্বৃত্ত তারল্য প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা ছিল, তা এখন কমে ৮০ হাজার কোটি টাকায় নেমে গেছে। যদিও এর বেশির ভাগই সরকারি কোষাগারে ঋণ আকারে রয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/307717