৫ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৯

চাকরি পাবো কোথায়?

খবরটি উদ্বেগের এবং বিবেচনার। বিশেষ করে উন্নয়নের যাত্রাপথে এমন একটি খবর উন্নয়নের দাবিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী শ্রমশক্তিতে যোগ হয়নি দেশে এমন মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৫৬ লাখ। এরা কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, এরা শ্রমশক্তির বাইরে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞানুযায়ী এদের বেকার বলা হচ্ছে না, তাই বলা হচ্ছে এরা কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়। আইএলও’র সংজ্ঞানুযায়ী একটি নির্দিষ্ট বয়সের ওপরের কোনো মানুষ, যিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ে এক সপ্তাহ অথবা একদিন কর্মে নিয়োজিত থাকলে কর্মে নিয়োজিত বলে বিবেচিত হবেন। এটা হতে পারে আত্মকর্মসংস্থান অথবা পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে।
এ ধরনের কর্মে নিয়োজিত থাকার সময় নগদে অথবা বিষয়ে সামগ্রীতে মজুরি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। আইএলও’র সংজ্ঞানুযায়ী কর্মহীনতা বলতে বোঝায়, যাদের কোনো কাজ নেই, যারা বিগত চার সপ্তাহ ধরে কাজ খুঁজছে এবং আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কাজে যোগ দিতে তৈরি আছে অথবা কর্মহীন মানুষ যারা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কাজ পাওয়ার আশা করে। অনেকে মনে করেন, এই সংজ্ঞা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

সংজ্ঞা যাই হোক না কেন, দেশে যে প্রতিদিন কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারি খাতে প্রচুর পদ খালি থাকলেও সেখানে নিয়োগ হচ্ছে না। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়ায় শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটছে না এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে না। বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। ফরাসি লেখক অলিবেয়ার কামু এই কর্মহীনদের বলেছেন ছায়াহীন মানুষ। বাংলাদেশে এই ছায়াহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে কর্ম উপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৮০ লাখ। বাকি ৪ কোটি ৮০ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম কিন্তু শ্রমশক্তির বাইরে। এদের মধ্যে নারী, পুরুষ, শিক্ষিত, শিক্ষাহীন সব ধরনের মানুষ আছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই হিসাব আনুযায়ী দেশের প্রায় ৩৩ ভাগ অর্থাৎ প্রতি তিনজনে একজন বেকার।

যারা বর্তমানে কর্মে নিয়োজিত, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক অর্থাৎ ২ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ নিয়োজিত আছেন কৃষি ক্ষেত্রে। শিল্পে যুক্ত আছেন ১ কোটি ২৪ লাখ মানুষ। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ধরনের সেবা খাতের সম্প্রসারণের ফলে এত মানুষ সেবা খাতে জড়িত হয়েছে। অন্যদিকে কৃষিতে যে রূপান্তর ঘটছে, এর ফলে ভবিষ্যতে এ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে।
দেশে কর্মহীন মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ এবং এটাই স্বাভাবিক। শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষের মধ্যে ৩ কোটি ৬৩ লাখ পুরুষ এবং ১ কোটি ১৯ লাখ নারী। পুরুষের কর্মহীনতা পুরুষশাসিত সমাজে মারাত্মক সমস্যা তৈরি করে। পরিবারে অন্নের জোগানদাতা হিসেবে পুরুষকে দায়িত্ব পালন করতে হয় বলেই সে কর্মের পেছনে ছুটে বেড়ায় কিন্তু কর্মের সন্ধান পায় না। কর্মের সন্ধান পেলেও অনেককে আন্ডার অ্যামপ্লয়মেন্টের শিকার হতে হয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে সম্পৃক্ত থেকে যারা জীবন অতিবাহিত করেন, তারা কোন শ্রেণীতে পড়েন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

বাংলাদেশ প্রতিবছর কর্মক্ষম কত লোক শ্রম বাজারে প্রবেশ করে? দেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, ডিগ্রিধারী কত মানুষ প্রতিবছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। তবে শিক্ষাজীবন শেষে সবাই যে বেকারত্বের জগতে প্রবেশ করে, এমন নয়। মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা মাদ্রাসা ও মসজিদকেন্দ্রিক কর্মে নিয়োজিত হতে পারে।
এ দেশে কাজ খুঁজে পাওয়াও কঠিন ব্যাপার। অনেকে কাজ খুঁজতে খুঁজতে অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়ে হতাশ হয়ে পড়েন, মনে করেন- চাকরির দরখাস্তের জন্য ব্যাংক ড্রাফট অথবা পে-অর্ডারের পেছনে টাকা খরচ করে কী হবে! ‘মামুর জোর’ না থাকলে তো চাকরি পাওয়া যাবে না। তাই অনেকেই ভিন্নভাবে জীবন ধারণের ফন্দি-ফিকির আঁটেন। এইচএসসি পাস হয়ে যান শিশু বিশেষজ্ঞ।
আবার কর্মের সংখ্যা বাড়ছে না বলে প্রতিযোগিতা এবং দুর্নীতি উভয়ই বাড়ছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কয়েকটি খবর এখানে তুলে ধরলে কর্মহীনতার ধারাবাহিক চিত্র পরিস্ফুট হবে। ১৫ মার্চ ১৯৭২, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে- মুন্সীগঞ্জে প্রাইমারি শিক্ষকের ৬০টি পদের জন্য ১ হাজার ২০০ প্রার্থী বাছাই পরীক্ষা দিতে উপস্থিত হয়েছেন। ৪ জুলাই ১৯৭২, প্রকাশিত খবরে বলা হয়- চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলায় বেকারের সংখ্যা ১৩ লাখ, এর মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ শিক্ষিত বেকার।

৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে- কুমিল্লায় একটি ব্যাংকের ২৫টি পদের জন্য ৮ হাজার প্রার্থীর দরখাস্ত পাওয়া গেছে। বিগত কয়েক দশকে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন খুব একটা হয়নি। একটি পরিবর্তন দেশের অর্থনীতিতে শক্তি জুগিয়েছে, তা হল- শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত, দক্ষ, অদক্ষ মানুষের কর্মের সন্ধানে বিদেশ যাত্রা। দেশে এদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। কর্মের সংখ্যা সীমিত বলেই বিভিন্ন সরকারি পদে চাকরি প্রাপ্তি এখন অনেক ক্ষেত্রেই অর্থনির্ভর। বলা হয়- পুলিশ ও শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে একটি চাকরির জন্য ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।

যিনি এ পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে চাকরি কিনবেন, তিনি কর্মে যোগদানের পর বিভিন্ন কৌশলে এ টাকা তুলে নেয়ার সার্বক্ষণিক কর্মে নিয়োজিত হবেন। আবার অনেকে আছেন, যারা খণ্ডকালীন বেকার। বাড়ি নির্মাণ জ্ঞানের অধিকারী এমন অনেকেই আছেন, যারা একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাট নির্মাণের সময় কর্মে নিয়োজিত থাকেন। কাজ ফুরালেই আবার কাজ খুঁজতে বেরোন। এরা পূর্ণকালীন কর্মগ্রহণ করতে পারেন না। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে বলা হয়েছে- দেশে খণ্ডকালীন বেকারের সংখ্যা ১৪ লাখ ৬৫ হাজার, যারা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার কম কাজ করেন।

যতই দিন যাবে, ছায়াহীন মানুষের মিছিলের লাইন দীর্ঘ হবে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বেসরকারি খাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না হওয়ায় বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। এটা বাস্তব। অভিযোগ আছে, বেসরকারি খাতের অনেকেই নতুন বিনিয়োগের চেয়ে পুরনো বিনিয়োগের অর্থ বিদেশে পাচারেই অধিক আগ্রহী। অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজে বিরাজমান দ্বন্দ্ব অবসানের একটা পথ তৈরি হয়। কিন্তু নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়, নষ্ট হয় স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ছায়াহীন মানুষের মিছিল কিভাবে ছোট হবে অথবা অন্যভাবে বললে চাকরি পাব কোথায়? নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হলে এই চাকরি প্রত্যাশীদের ভিড় ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অবশ্য গত এক দশকে এদেশের অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে বৈষম্য বেড়েছে, সম্পদ চলে যাচ্ছে এমন কিছু লোকের হাতে, যারা কর্মসৃষ্টিতে যত না উৎসাহী- তার চেয়ে বেশি উৎসাহী দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সালে মোট দেশজ আয়ের শতকরা ২৪.৬ ভাগের মালিকানা ছিল মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষের হাতে। ২০১৬ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৯ শতাংশ। অঙ্কের হিসাবে এটা বিরাট অঙ্ক। অন্যদিকে ৫ শতাংশ মানুষের আয় ২০১০ সালের ০.৭৮ শতাংশ থেকে কমে ২০১৬ সালে ০.২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই সম্পদ ঘনীভবনের কারণে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিত্তশালীদের প্রভাব বাড়ছে। সংসদ সদস্যরা নির্বাচনের আগে তাদের আয়ের যে হিসাব দেন আর পাঁচ বছর পরে সম্পদের মালিকানা যা দাঁড়ায়- তাতে এটা স্পষ্ট যে, এ প্রক্রিয়ায় কিছু ব্যক্তি লাভবান হলেও সমাজের কোনো উপকার হচ্ছে না। এজন্য তাদের কোনো তদন্তও মোকাবেলা করতে হয় না।

অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়লে সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। সহায়, অসহায়ের, বিত্তবান ও বিত্তহীনের মাঝে সংঘাতের আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠার অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু সেটা কেমন করে সম্ভব হবে? ৩ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, বর্তমান অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৭৫২ মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। এই হিসাব গড়ের হিসাব। কিন্তু এই গড়ের হিসাবে কি বেকারদের আয় অন্তর্ভুক্ত হবে? কর্মের সুযোগের সম্প্রসারণ না হলে সংকট কাটবে না। নিশ্চিত হবে না টেকসই উন্নয়ন। উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যে জনশক্তি হতে পারত উন্নয়নের চালিকাশক্তি, তারা তো সেই বাহন চালাতে পারছে না।
মাহফুজ উল্লাহ : শিক্ষক ও সাংবাদিক
mahfyu.1950@gmail.com

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/35082