৫ এপ্রিল ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৯

শান্তির ডাক দিলেন ইমাম সাহেব

মাদরাসা নিয়ে নানারকম প্রচারণা আছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তেমন প্রচারণা লক্ষ্য করা যায়। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক কমিটির সভায়ও বাংলাদেশের মাদরাসা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। ১৫ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য রাশিয়ার আসলান আবাসিদজে বলেন, সরকার শিক্ষানীতিতে মাদরাসা ছাত্রদের জন্য ইংরেজিসহ কয়েকটি বিষয় জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কওমি মাদরাসাগুলো জাতীয় পাঠ্যক্রমের আওতায় আসতে রাজি নয় এবং এসব মাদরাসায় উগ্রবাদ প্রসারের অভিযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে উগ্রবাদ বিস্তারের সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনা কী, তা তিনি জানতে চান। এর জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, মাদরাসায় উগ্রবাদের প্রসার হয়, সরকার এমনটি মনে করে না এবং সে কারণেই মাদরাসা শিক্ষাকে মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

জাতিসংঘ কমিটির উক্ত বৈঠকে মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে রদবদল ঘটানোর অভিযোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রাশিয়ার প্রতিনিধি আবাসিদজে তার উদ্বেগের কথা জানান। তার প্রশ্ন ও উদ্বেগ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলা হয় হোলি আর্টিজানে, হামলাকারীরা কেউই মাদরাসা ছাত্র ছিল না। তারা হয় ইংরেজি মাধ্যমে নয়তো বিদেশে লেখাপড়া করেছে। সুতরাং সব মাদরাসাকে উগ্রবাদ প্রসারের জন্য দায়ী করা যায় না। এত বড় একটি জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন রাখা যায় না উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, তাদের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে। হেফাজতের দাবিতে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনের অভিযোগ তিনি নাকচ করে দেন।

১৭ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকায় জাতিসংঘ কমিটির ওই বৈঠকে রাশিয়ার প্রতিনিধির প্রশ্ন ও উদ্বেগের বিষয়টি মুদ্রিত হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষাকে যারা পছন্দ করেন না বরং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, তাদের উদ্বেগের সাথে রাশিয়ার প্রতিনিধির উদ্বেগ কি চমৎকারভাবে মিলে গেল! এটার কারণ কি রাজনৈতিক কিংবা জীবন দর্শনগত মিল? বাংলাদেশের প্রতিমন্ত্রী অবশ্য ওইসব উদ্বেগের যোগ্য জবাব দিয়েছেন। এ জন্য তাকে জানাই ধন্যবাদ।
এবার মাদরাসা শিক্ষিত এক ইমামের কথা বলতে চাই। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঠেকাতে অনুপম উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের একটি মসজিদের ইমাম। সেখানে রাম নবমী নিয়ে সৃষ্ট সহিংসতায় ইমাম মাওলানা ইমাদুল রশিদির ১৬ বছর বয়সী কিশোর ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু মাওলানা রশিদি প্রতিশোধ স্পৃহার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। বরং ছেলের জানাযায় উপস্থিত সকলের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা যদি আমার ছেলের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আমি এই মসজিদ ও শহর ছেড়ে চলে যাব। ঘটনা প্রসঙ্গে ইমাম রশিদি বলেন, ‘আমার ছেলেকে একদল দুর্বৃত্ত তুলে নিয়ে যায়। আমার বড় ছেলে তখন পুলিশকে বিষয়টি জানায়। কিন্তু তাকে পুলিশ স্টেশনে বসিয়ে রাখা হয়। পরে আমরা জানতে পারি যে, পুলিশ একটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে।’

বৃহস্পতিবার বিকালে স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে কিশোর সিবতুল্লাহ রশিদির জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ইমাম রশিদি শান্তির ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘আমি শান্তি চাই। আমার ছেলে চলে গেছে। আমি চাই না আর কোন পরিবার তাদের প্রিয় কাউকে হারাক। আমি চাই না আর কোন ঘর পুড়ে ছারখার হোক।’ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে আরো বলা হয়, আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি বলেন, সিবতুল্লাহ রশিদির হত্যাকা- নিয়ে মুসলমান যুবকরা উত্তেজিত ছিল। তাদেরকে শান্ত করতে ইমাম সাহেবের বার্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমরা ইমাম সাহেবকে নিয়ে গর্বিত। নিজের ছেলে হারানোর যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি শান্তির ডাক দিয়েছেন। এদিকে আসানসোল ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাসিম আনসারি বলেন, ‘এটি শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্যই নয়, পুরো দেশের জন্যই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তিনি যদি শান্তির ডাক না দিতেন তাহলে আসানসোলে আগুন জ্বলতো।’

হিন্দুত্ববাদী শাসকদল বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে সহিংসতা উপদ্রুত আসানসোলে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। উল্লেখ্য যে, রাম নবমীর একটি অনুষ্ঠান চলাকালে ধর্মীয় সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় আসানসোল জুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা ও একজন পুলিশ কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলার অভিযোগে মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে তালিকাভুক্ত করেছে স্থানীয় পুলিশ। শুধু আসানসোলে নয় পুরো পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই চলছে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। বৃহস্পতিবার দাঙ্গায় নিহত হয়েছে আরো ২ জন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়, হিন্দু ধর্মের উৎসব রাম নবমীকে কেন্দ্র করে রোববার শুরু হওয়া দাঙ্গা থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। এদিকে সিবতুল্লাহ রশিদি হত্যাকা- প্রসঙ্গে প্রশাসন বলেছে, আমরা দোষীদের বিচারের আওতায় আনবো। কাথার বাস্তবায়ন অবশ্যই দেখার মতো একটি বিষয় হবে।

ভাল উদাহরণ, ভাল আচরণ, ভাল জাতি আমাদের কাম্য। এ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন মা। আসলেই একজন ভালো মা একটি ভালো জাতি গঠন করে দিতে পারেন, সভ্যতাও। কারণ জাতি তো অনেকগুলো মানুষের সমষ্টি। আর প্রত্যেকটি মানুষকে জন্ম দিয়ে থাকেন মা। মায়ের কোলেই শিশুর বেড়ে ওঠা। মা শিশুকে কথা বলতে শেখান, দেখতে শেখান, ভালো-মন্দ উপলব্ধি দেন। শিশু ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে, মাও ধীরে ধীরে তার মধ্যে গড়ে তোলেন জীবনদৃষ্টি এবং মূল্যবোধ। শিশুর এই যে সচেতন পরিগঠন, এটাই আসলে জাতি গঠনের পাটাতন, যাকে আমরা বলতে পারি জাতি গঠনের ভিত্তি। পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে এমন ভিত্তি রচিত হলে আমরা পেতে পারি কাক্সিক্ষত সেই বিশ্ব।
বর্তমান পৃথিবীর তথা সভ্যতার যে হাল, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যরা যেভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন, শিশু পরিগঠনের ক্ষেত্রে মায়েরাও সেভাবে ব্যর্থতার নজির স্থাপন করে যাচ্ছেন। ফলে আমাদের সভ্যতার সংকট কাটছে না। এই সংকটের মধ্যেও আমরা আশাবাদী হতে চাই। কারণ আশাবাদই মানুষকে, পৃথিবীকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। আর আশাবাদী হওয়ার মত উদাহরণ যে একেবারে নেই, তা কিন্তু নয়। প্রসঙ্গত এখানে কানাডার অন্টারিও প্রদেশের এক মায়ের কথা উল্লেখ করতে চাই। স্কুল বাসের চালকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের কারণে নিজের দুই সন্তানকে সাত কিলোমিটার পথ হাঁটিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছেন তিনি।

এই সাত কিলোমিটার কিন্তু বাংলাদেশের মত ৭ কিলোমিটার নয়। কানাডার বর্তমান আবহাওয়ার কথা মাথায় রাখলেই বোঝা যায়, এই সাজা মোটেই সহজ কোনো সাজা নয়। কারণ দেশটিতে তখন তুষারপাত হচ্ছিল। ঠা-ায় কুঁকড়ে যাওয়ার মত অবস্থা বড়দের। শিশুদের অবস্থা তো আরো নাজুক। এখন জানার বিষয় হলো, শিশু দু’টির অপরাধ কী ছিল? স্কুলের বাসচালকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার বিষয়টি শিশু দু’টির মাকে জানিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। এরপরই অভিনব কায়দায় সন্তানদের সাজা দেন তিনি। ফেসবুকে সন্তানদের সেই ছবি পোস্ট করে ওই মা লিখেছেন, ‘আমার বাচ্চারা তাদের স্কুলের বাসচালকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল। স্কুলের পক্ষ থেকে ঘটনাটি জানানো হয়। তাই তাদের ৭ কিলোমিটার হাঁটিয়ে স্কুলে নেয়া হয়। কারণ, স্কুলের বাস তাদের আর না নিলে প্রতিদিন কতক্ষণ হাঁটতে হবে, সেটা বোঝা দরকার তাদের।’ তিনি আরও লিখেছেন, দুই ঘণ্টা হাঁটার পর বাস্তবতা বুঝতে পেরেছে তারা। মায়ের সাজার কারণে বাস্তবতা বুঝতে পারলো শিশু দু’টি। এ কারণে তারা এই বার্তাটিও শৈশবে পেয়ে গেল যে, খারাপ ব্যবহার করা একটি অপরাধ এবং এজন্য শাস্তিও পেতে হয়। এমন অভিজ্ঞতা ওই শিশুদের যে কোনো অপরাধ থেকে দূরে রাখবে বলে আশা করা যায়। আর এ ঘটনা থেকে এই বিষয়টিও উপলব্ধি করা যায় যে, মা শিশু দু’টিকে ভালোবাসেন বলেই শৈশব থেকেই ওদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। শিশু পরিগঠনের এমন কাজ আসলে জাতি গঠনেরই কাজ, বলা যেতে পারে আসল ভিত্তি। কিন্তু ভিত্তি গঠনের এই কাজটি কতজন মা করছেন, কতজন অভিভাবক করছেন? করছেন না বলেই আমরা কাক্সিক্ষত সমাজ ও দেশ পাচ্ছি না, পাচ্ছি না সভ্য পৃথিবীও। তাই আবারও ওই কথাটি উচ্চারণ করতে হয়, ‘পশু-পাখি সহজেই পশু-পাখি, কিন্তু মানুষ সহজে মানুষ নয়।’ তাই মানুষ গড়ার কঠিন কাজটির দিকে এখন ব্যক্তি মানুষের এবং সভ্যতার নজর দেয়া প্রয়োজন।

http://www.dailysangram.com/post/325379