৪ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ১০:০৪

লাইসেন্স ছাড়াই বিমান উড়াচ্ছেন দুই অপারেশন ম্যানেজার

জেদ্দা ও দিল্লি স্টেশনের দুই এফওওকে দেশে তলব; দুর্ঘটনা ঘটলে ইন্স্যুরেন্স পাবে না বিমান ও যাত্রীরা

ফাইট অপারেশনের প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। জেদ্দা ও দিল্লি এই দু’টি স্টেশনে দায়িত্বরত ফাইট অপারেশন অফিসারদের (এফওও) লাইসেন্স দীর্ঘ দিন নবায়ন না হলেও তারা কিভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং পেলেন তা নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু আন্তর্জাতিক এভিয়েশন আইনই অমান্য করা হয়নি গোটা বিমান ও যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থাকে তারা হুমকির মুখে ফেলেছেন বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

সম্প্রতি কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশী বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলার ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট সব মহলের টনক নড়ে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেরও দুর্বল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা ও নাড়াচাড়া হতে থাকে। এরই ফলে কর্তৃপক্ষ কিছু পরিবর্তন ও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ।
জানা যায়, বিশ্বের যতগুলো স্টেশনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফাইট যাতায়াত করে সব ক’টি স্টেশনে ফাইট অপারেশন বিভাগ কাজ করে। এখানে দায়িত্বরতদের খুব অভিজ্ঞ ও সিভিল এভিয়েশন অথরিটি কর্তৃক প্রদত্ত বিশেষ প্রশিক্ষণের এফওও লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। প্রতি বছর এ লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। অন্যথায় ওই অফিসার দায়িত্বে থাকার অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। শুধু তাই নয়, ওই অফিসারের দায়িত্বে থাকাকালীন কোনো বিমান দুর্ঘটনা হলে সেই ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীরা আন্তর্জাতিক ইন্স্যুরেন্সের দাবি করতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে একজন এয়ারলাইন্স বিশেষজ্ঞ নয়া দিগন্তকে বলেন, বিমানের একজন অপারেশন ম্যানেজারের দায়িত্ব অনেক। পুরো ফাইট প্লানটাই তাকে তৈরি করতে হয়। এরমধ্যে বিমান কতক্ষণ আকাশে উড়বে, কখন অবতরণ করবে, জ্বালানি কি পরিমাণ লাগবে, কোন কোন দেশের ওপর দিয়ে উড়ে আসবে, কত ফুট উপর দিয়ে উড়বে, কোন ক্যাপ্টেন, ফার্স্ট অফিসার বিমান চালাবে, কি মডেলের এয়ারক্রাফট থাকবে সবকিছুই থাকে তার প্লানে।

কিন্তু সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ চিত্র। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জেদ্দায় দায়িত্বরত অপারেশন ম্যানেজার দীর্ঘ ৭ বছর ধরে লাইসেন্স ছাড়াই ফাইট পরিচালনার (ডেসপাস) দায়িত্ব পালন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি তার অনিয়মের বিষয়টি বিমান ম্যানেজমেন্টের নজরে এলে তাৎক্ষণিক ওই কর্মকর্তাকে দেশে ফেরাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত নাসির উদ্দিন আহমদ নামে ওই কর্মকর্তা জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই অবস্থান করছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, নাসির উদ্দিন আরো এক মাস সেখানে থাকতে বিমানের শীর্ষ এক কর্মকর্তাকে দিয়ে তদবির করছেন।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন ফাইট অপারেশন ম্যানেজারের মূল কাজ হচ্ছে উড়োজাহাজ উড্ডয়নের পর সেটি নিরাপদে অবতরণ করানো পর্যন্ত পুরো ফাইট প্ল্যান তৈরি করা। যদি এই সময়ের মধ্যে উড়োজাহাজে বড় ধরনের কোনো অনাকাক্সিত ঘটনা ঘটে, তাহলে বিমান বাংলাদেশ এযারলাইন্স কর্তৃপক্ষ ইন্স্যুরেন্সের ক্ষতিপূরণের কোনো টাকাই পাবে না। তার এই গাফিলতি আর অনিয়মের সাথে যারাই জড়িত তাদের শনাক্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করছেন তারা।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিমানের ফাইট অপারেশন বিভাগের (জিএম সেন্ট্রাল কন্ট্রোল) জেনারেল ম্যানেজার আশরাফুল হক বাদলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জেদ্দায় বিমানের ফাইট অপারেশন ম্যানেজার নাসির উদ্দিনের লাইসেন্স নবায়ন না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, এত দিন নাসির উদ্দিন কিভাবে সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন সেটি আমার জানা নেই। তবে এই পদে কিছু দিন আগে আমি যোগদান করার পর তার লাইসেন্স নবায়ন না থাকার বিষয়টি অবহিত হয়েছি। সাথে সাথে তার কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি এবং তাকে দেশে চলে আসতে বলেছি। তিনি বলেন, নাসির উদ্দিন আমার অধীনে চাকরি করলেও এ ব্যাপারে আমি আর বেশি কিছু বলতে পারছি না। তবে এতটুকু বলতে পারি, বিষয়টি জানার পর থেকেই জেদ্দা থেকে তার স্বাক্ষরে ছেড়ে আসা কোনো ফাইটই আর ডেসপাস হচ্ছে না। ডেসপাসের সই আমরা ঢাকা থেকেই করে দিচ্ছি।
শুধু জেদ্দা বিমানবন্দরেই নয়, একইভাবে দিল্লিতেও অপারেশন ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা শফিকুল ইসলামেরও দীর্ঘ দিন ধরে লাইসেন্স নেই। তার ব্যাপারে জানতে চাইলে এই অভিযোগের বিষয়টিও স্বীকার করে জিএম আশরাফুল হক বাদল বলেন, শফিকুল ইসলামের জায়গায় জাহিদুল ইসলাম নামে এক কর্মকর্তাকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জেদ্দা স্টেশন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাসির উদ্দিন আহমদ জেদ্দায় ৭ বছর ৪ মাস ধরে অপারেশন ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু এ পদের দায়িত্ব পালন করতে হলে তাকে অবশ্যই সিভিল এভিয়েশন অথরিটি থেকে ট্রেনিং করে লাইসেন্স নবায়ন করার কথা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তার লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। এরপরও তিনি দীর্ঘ দিন ধরে জেদ্দা-সিলেট-ঢাকা এবং জেদ্দা-চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে ফাইট ডেসপাসের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার এই কর্মকাণ্ডের বিষয়টি জানাজানি হয় মাস তিনেক আগে। এরপরই বিমানের বলাকা ভবনে ফাইট অপারেশন বিভাগের পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে নাসির উদ্দিনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। তলব করা হয় তার নথি। বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ তাকে দেশে ফিরতে চিঠি ইস্যু করে। এর পর থেকেই তিনি বদলি ঠেকাতে তদবির শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি প্রভাবশালীদের দিয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে তদবির করে আরো এক মাস সময় বাড়িয়ে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (ফাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামিলের সাথে গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে জিএম আশরাফুল হক বাদলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি বিষয়টি জানার পরই তার ডিউটি অফ করে দিয়েছি। এখন তার জায়গায় খুরশীদ ইসলাম নামে এক কর্মকর্তাকে পাঠানো হচ্ছে। ভিসা জটিলতার কারণে তিনি এখনো জেদ্দায় যেতে পারেননি। এক মাস সময় বাড়ানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। গত রাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জেদ্দায় অবস্থানরত স্টেশন ম্যানেজার নাসির উদ্দিন আহমদের সাথে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/307410