৪ এপ্রিল ২০১৮, বুধবার, ৯:৫৪

সব রসুনের এক মুথা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : শিক্ষমন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ একেবারে কোনো রাখঢাক না রেখে বলে ফেলেছিলেন যে, তিনিসহ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সকল মন্ত্রী এমপি চোর। তাই যদি হবে, তা হলে তো আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার বলার কিছু থাকে না। তারা যদি চোর হন, তা হলে চুরি করতে সরকারি কর্মকর্তাদের তিনি বাধা দিবেন কি করে। তার মন্ত্রণালয়ও চোরদের এক বিশাল আখড়া। সে ব্যাপারে তিনি যথার্থই অবহিত আছেন। তবে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার জন্য সেখানে সাধারণ সেবা প্রার্থীরা অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হন। ফলে অসহায় মন্ত্রী দুর্নীতি রোধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং কর্মকর্তাদের এই বলে পরামর্শ দিলেন যে, আপনারা ঘুষ খান, কিন্তু সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খান। এই সহনীয় মাত্রাটা যে কি তার ব্যাখ্যা মন্ত্রীর কাছে ছিল না। ফলে যথা পূর্বং তথা পরং। ঘুষ দুর্নীতি আগের মতোই সমানতালে চলতে শুরু করেছে। এটা শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়েই নয়, যেখানেই যাবেন ঘুষের খেলা। ঘুষ না দিলে ফাইল এ টেবিল থেকে ও টেবিল যায় না। সে টেবিলে ফাইল পড়ে থাকে। ঘুষ না দিলে নড়ে না। এভাবেই এখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলছে।

এই ঘুষ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বোধকরি সকল মিডিয়াকেই মনে করছেন। সরকারে যত বড় প্রকল্প তত বড় দুর্নীতি। আর সে কারণে বাংলাদেশের সড়ক নির্মাণে কিংবা ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। যথাসময়ে কোনো কাজই শেষ হয় না। কাজ শেষ না হলে সময় বাড়ে, সময় বাড়লে খরচও ধাপে ধাপে বাড়িয়ে দেখানো হয়। যদি ঠিকাদার যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন না করতে পারেন, তাহলে তার জরিমানা হওয়ার কথা। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে তার খরচ বাড়িয়ে দেয়া হয়। সে টাকা কি ঠিকাদার একা খায়? নিশ্চয়ই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার ভাগিদার। এভাবেই লুণ্ঠনের মুখে পড়েছে রাষ্ট্র। সরকার দুর্নীতিকে যেন লাইসেন্স প্রদান করেছে। দুর্নীতি হবেই। রোধের কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার তাদের সামনে যেন একাত্মতা ঘোষণা করেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই দুর্নীতির পক্ষে এই বলে সাফাই গেয়েছেন যে, প্রকল্পের সময় যদি বাড়ে, তাহলে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে। সময় কেন বাড়বে, ব্যয় কেন বাড়বে, তার পক্ষে তিনি কোনো যুক্তি দেখাতে পারেননি। দেশের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি এমনই শাখা প্রশাখা বিস্তার করে নাগরিকদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। নিরুপায় নাগরিক অসহায়। তারা এ সব দুর্নীতিবাজের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
কিন্তু মিডিয়ায় মাঝে মাঝে এই দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়। লুণ্ঠনের খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বোধকরি সরকার খানিকটা লজ্জাবোধও করে। আর সে কারণে এসব সংবাদ প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য তারা নতুন নতুন আইনের ফন্দি করে। প্রথমে তারা করলো সাইবার অপরাধ আইন। সে আইনের ৫৭ ধারায় এমন ব্যবস্থা করা হলো যে সাংবাদিকরা যে কোনো দুর্নীতির বিষয়ে টু শব্দটিও করতে পারবে না। সঙ্গে সঙ্গে তাদের টুঁটি চেপে ধরা হবে। তার প্রমাণও আমরা পেয়েছিলাম ৫৭ ধারায় বহু সংখ্যক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সরকার মামলা দায়ের করে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করেছে। এবং সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে ৫৭ ধারা যদি রদও হয়, তাহলে দায়েরকৃত মামলাগুলো চলতে থাকবে। অর্থাৎ সাংবাদিকদের মাথার ওপর উদ্যত খড়্গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই ৫৭ ধারা নিয়ে সাংবাদিক সমাজ এবং সুশীল সমাজ একযোগে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। ফলে সরকার খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে নতুন আইন করেছে সাইবার নিরাপত্তা আইন। আইনটি এখনো পাস হয়নি। কিন্তু সেটি আরো ভয়ঙ্কর। আর তার সব কিছুই সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে। তাতে সাংবাদিকতা করার সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতির খবর যাতে প্রকাশিত না হয়, তার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সাংবাদিক যদি কৌশলে দুর্নীতির তথ্য বের করে, তবে তাকে গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করে কঠোর দ- দেয়া যাবে। অর্থাৎ দুর্নীতির পক্ষে দাঁড়িয়েছে সরকার। গোপনে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না। গোপন ক্যামেরায় দুর্নীতির কোনো তথ্য ধারণ করা যাবে না। কিংবা কোনো কথোপকথনও ধারণ করা যাবে না। করলেই তা হবে গোয়েন্দাবৃত্তি। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। তাছাড়া কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে পুলিশের কোনো নি¤œপদস্থ কর্মকর্তা যদি মনে করেন, তিনি অপরাধ করতে পারেনÑ তাহলেও তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আমার চেহারা দেখেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা এই মর্মে ধারণা করতে পারেন যে, এ হয়তো কোনো অপরাধ করতে পারে, অতএব আটক কর। এজন্য আদালতের কোনো অনুমোদন লাগবে না। তার দায়ভার কিংবা দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার কাছেই ন্যস্ত করা হয়েছে। এই নিয়ে দেশব্যাপী এখনো প্রতিবাদ চলছে। সাংবাদিক সমাজ, সুশীল সমাজ একে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে মনে করছেন।

এটিতো খুব স্বাভাবিক, যে ব্যক্তি অপরাধ করেননি, তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে, অপরাধ করতে পারে এরকম সন্দেহ করে গ্রেফতার করা কোনো সভ্য দেশের রীতি হতে পারে না। শুধু দেশেই এর প্রতিবাদ হয়নি, সারা বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিছুকাল আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ১০টি দেশের কূটনীতিকরা একযোগে সরকারকে বলেছেন যে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৩২ নম্বর ধারা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। অতএব এই ধারা যেন অন্তর্ভুক্ত করা না হয়। এখন পর্যন্ত আইনটি পাস হয়নি, পাস করলেও কিছু করবার নেই। সাংবাদিক সমাজ ও সুশীল সমাজ মিলে কত সংখ্যক লোকইবা আর হবে। তাদের কথায় কর্ণপাত না করলে সরকারের কী যায় আসে। সুতরাং সরকার সে পথেই হাঁটছে। যে কোনো সময় এই আইন পাস হতে পারে। মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে দিয়েছে। এখন সংসদের আনুষ্ঠানিকতা বাকি। সেটি তো প্রধানমন্ত্রীর এক কথার উপর নির্ভর করে। তার মতের বাইরে কথা বলার মতো লোক সংসদের ভিতরে কোথায়ও নেই, মন্ত্রীদেরও নেই। ফলে এখন দেশে এক ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার শাসন চালু হয়েছে। এই আইন নিয়ে যখন আলোচনা হয়েছিল তখন সরকারি আমলাদের সে কি উৎসাহ! তাদের বিরুদ্ধে কে কোথায় কবে কি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাই নিয়ে তারা তোলপাড় তুলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব সাংবাদিকদের একহাত নিয়ে ছেড়েছিলেন। সে মুখ্য সচিব দ’ুদফা এক্সটেনশনের পর এখন রাস্তায় নেমে এসেছেন। এবার কি হবে? তার অতীতের সমস্ত দুর্নীতির খবর যদি প্রকাশিত হতে থাকে, তাহলে তিনি বড়জোর মামলা করতে পারবেন। সরকারি প্রভাব ব্যবহার করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রেও তিনি সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা ব্যবহার করবেন। কিন্তু ফলাফল খুব সুবিধার হবে না।
সমাজের এরকম একটি অবস্থার সাম্প্রতিক প্রধান খবর হলো ব্যাংক লুট। সরকার একের পর এক নতুন ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছে। তার বেশির ভাগই লুটেরা। জনগণের সব টাকা তারা আত্মসাৎ করে বসে আছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে সব টাকা ব্যাংকে থাকে সে সব টাকার অর্ধেক এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরেক দফা লুটের আয়োজন। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজনীতিক বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আরো ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হবে। প্রক্রিয়াধীন আছে বেশ কয়েকটি। ধারণা করা যায়, সেখানেও লুণ্ঠনেরই আয়োজন চলবে। সব চাইতে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছে আওয়ামী লীগের এমপি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক।

তার মধ্যে আমরা নতুন কা- দেখলাম, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এক আজব দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর স্বার্থে সংবাদ প্রকাশ করা নিয়ন্ত্রণ করা হোক। ফিনান্সিয়াল ইনফরমেশন এ্যাক্ট প্রণয়ন করে ব্যাংক সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করা বন্ধ করা হোক। ব্যাংকিং খাতের অর্থ সংকট ও উচ্চ সুদ সমস্যা সমাধানের করণীয় নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এই দাবি জানিয়েছে বিএবি। বিএবি তাদের চিঠিতে উল্লেখ করেছে, গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হলে গ্রাহক ও জনসাধারণের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়। তারা ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। ব্যাংকিং খাতে আমানত বৃদ্ধি করতে হলে সরকার ও বাংলাদেশের ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংক সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ ঠেকাতে আর্থিক তথ্য আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই আইন প্রয়োগের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে। অনেক সময় সাংবাদিকরা ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন। এতে ব্যাংকগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশের স্বার্থে নেতিবাচক সংবাদ এড়িয়ে চলা উচিত।
এ এক অকল্পনীয় দাবি। এমনিতেই সরকার নানা পদ্ধতিতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। তারপর সরকারকে এ চাপ দিয়ে আরো বেশি সুবিধা নিলেন বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা। নেবেনই না বা কেন। কারণ নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলো মালিকানা কোনো না কোনোভাবে সরকারি লোকদের হাতে রয়েছে।

ফলে তারা লুট করে যাবে, জনগণের আমানতের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না, সরকারের আমানতের টাকাও ফেরত পাওয়া যাবে না। কিন্তু চুপ করে থাকতে হবে। এ সম্পর্কে যেন সাংবাদিকরা টু শব্দটিও করতে না পারে।
সবাই চান সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণ। আমরা সবাই জানি দেশে সংবাদপত্রগুলো এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া সেলফ সেন্সরড। বহু খবর তারা এড়িয়ে চলে। তার ওপর নতুন নতুন আইন করে সরকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশ বন্ধের এই অপচেষ্টা রাষ্ট্রকে লুটের আয়োজন মাত্র আর কিছু না। সব রসুনের যেমন এক মুথা, তেমনি সব লুটেরাও এখ এককাট্টা।

http://www.dailysangram.com/post/325252