৩ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:১৮

চাপে সিআরআর হার কমানো নজিরবিহীন

অযোগ্যদের মাঝে ঋণ বিতরণ বেড়ে যাবে : মির্জ্জা আজিজ ; বাংলাদেশ ব্যাংকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত : এম কে মুজেরী ; জনগণের সম্পদ আরো লুণ্ঠন হবে : আনু মুহাম্মদ

ব্যবসায়ীদের চাপে সাধারণের আমানত সুরক্ষা করতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) কমা নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, এতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মর্যাদা যেমন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, তেমিন অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার অযোগ্যদের মাঝে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি খেলাপি ঋণ যেমন বাড়বে, তেমনি আমানতকারীদের আমানতও ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে।

জানা গেছে, জনগণের আমানত সুরক্ষা করতে আমানতের একটি অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক জমা রাখতে হয়। এর মধ্যে একটি অংশ নগদে রাখতে হয়, যাকে সিআরআর বলে। যেমন, ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে সাড়ে ৬ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হয়। আরেকটি অংশ সম্পদ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হয় যাকে এসএলআর বলা হয়। গত রোববার ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েন অব ব্যাংকস (বিএবি) নেতৃবৃন্দের চাপে সিআরআর হার ১ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যা ওই দিন সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যা ঘোষণা করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের। এর ফলে বাজারে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়তে হবে। এর পর থেকেই নানা সমালোচনা করতে থাকেন অর্থনীতিবিদেরা। গতকাল এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরও দফায় দফায় প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সিআরআর হার কমানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হয়েছে। কারণ, কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বাড়ছে। যদি গত দুই মাসের পরিসংখ্যানও ধরা হয়, তাতেও দেখা যায় বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণ হয়েছে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হারে। যেমন গত জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, ফেব্রুয়ারি মাসের হিসাবে ১৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। সুতরাং ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট হলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হারে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করে কিভাবে? অপর দিকে, ব্যাংকাররাই বলেন, ভালো উদ্যোক্তা পাওয়া যায় না। যারা ঋণ নিচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এখন সিআরআর বাড়ানোর কারণে ব্যাংকে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাবে। এতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অযোগ্যদের মাঝে ঋণ বিতরণ আরো বেড়ে যাবে। এ কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাবে। এটা একেবারেই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
ব্যবসায়ী পরিচালকদের চাপে সিআরআর হার কমানোর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপচিালক অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী। তিনি গতকাল এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল অর্থনীতির স্বার্থেই। কারণ, মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য থাকে বাজারে টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ রেখে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় রাখা। দেশের অর্থনীতি যেন চাপের মুখে না পড়ে সে জন্য মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে ঋণ আমানতের অনুপাত (এডিআর রেশিও) কমিয়ে ছিল। অর্থনীতির স্বার্থে সিআরআর কমানোর প্রয়োজন হলে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে করা হলে ভালো হতো। এ নিয়ে কেউ প্রশ্নও করত না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মর্যাদা প্রশ্নের মুখে পড়ে, তেমনি অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তিনি মনে করেন, যেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে হোটেলে ডেকে নিয়ে সিআরআর হার কমানোর মতো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলো তা মোটেও যুক্তিসঙ্গত হয়নি। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, মুদ্রা সরবরাহেই বা কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা সামনে দেখা যাবে।
ব্যাংকের কিছু ব্যবসায়ী পরিচালকদের চাপে সিআরআর হার কমানোর সিদ্ধান্তকে দেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন নজির স্থাপন বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, প্রথমে কয়েকটি ব্যাংকিং খাতকে কয়েকটি পরিবারের হাড়ে তুলে দেয়ার জন্য আইন পরিবর্তন করা হলো। একই পরিবারের দুইজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক রাখার জন্য আইন সংশোধন করা হলো। এর ওপর তাদেরই চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআরআর হার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি বলেন, আগে সিদ্ধান্ত আসে। পরে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হোটেলে ডেকে নেয়া হয়। যেমনভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে হোটেল সোনারগাঁওয়ে ডেকে নিয়ে সিআরআর হার কমানোর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হলো। আসলে প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কাজ করছে না। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ মনে করেন, ব্যাংকের জনগণের সম্পদ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠনের বৈধতা দেয়ার জন্য নীতিমালাগুলো পরিবর্তন করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক থেকে জনগণের সম্পদ আরো লুণ্ঠন হয়ে যাবে। ব্যাংকের ওপর জনগণের আস্থাহীনতা আরো বাড়বে। যার সরাসরি প্রভাব অর্থনীতির ওপর পড়বে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/307090