৩ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:১০

অর্জনের আগেই উদযাপন এবং স্বৈরাচারের ভূষণ!

সুশাসন

জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্বব্যাংক একটি দেশের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়কে ভিত্তি ধরে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে। যথাÑ স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত। স্বল্পোন্নত দেশ বলতে এমন সব দেশকে বোঝায়, যেগুলোর মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় এক হাজার ২৩০ মার্কিন ডলারের নিচে। উন্নয়নশীল দেশ হলো এমন সব দেশ, যেগুলোর মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় এক হাজার ২৩০ ডলার থেকে ১২ হাজার ২৩৫ ডলারের মধ্যে। যেসব দেশের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় ১২ হাজার ২৩৫ ডলারের বেশি সেগুলো উন্নত দেশ। আবার উন্নয়নশীল দেশগুলো মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে নি¤œ-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ নামে অভিহিত। নি¤œ-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় এক হাজার ২৩১ ডলার থেকে তিন হাজার ৯৫৫ ডলারের মধ্যে। অপর দিকে, উচ্চ-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় তিন হাজার ৯৫৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ২৩৫ ডলারের মধ্যে।

একটি দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে : মাথাপিছু আয় এক হাজার ২৩০ ডলারের বেশি হওয়া, মানবসম্পদ সূচকে প্রয়োজন ৬৬ বা এর অধিক হওয়া এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ বা এর নিচে। উপরিউল্লিখিত তিনটি শর্তের মধ্যে প্রথমটির ক্ষেত্রে দেখা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় এক হাজার ২৭১ মার্কিন ডলার, মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের অর্জন ৭২.৯ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৪.৮।

বাংলাদেশ উপরিউল্লিখিত তিনটি শর্ত পূরণ করায় জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের (ইকোসক) সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি দেয়া হয়। স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হতে হলে আরও ছয় বছর অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে তিন বছর পর অর্থাৎ ২০২১ সালে ইকোসক বাংলাদেশ অর্জিত যোগ্যতা ধরে রাখতে পেরেছে কি না, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে। বাংলাদেশ অর্জিত যোগ্যতা ধরে রাখতে সক্ষম হলে ইকোসক আবার ২০২৪ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে এবং যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি দেয়ার পর পর দু’মেয়াদ তা ধরে রাখতে পারার কারণে ২০২৪ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

বর্তমান বছর বাংলাদেশের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার আরো দু’টি রাষ্ট্র স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ দু’টি রাষ্ট্রের একটি মিয়ানমার, অপরটি লাওস। যোগ্যতা অর্জন বিষয়ে স্বীকৃতি প্রদান-পরবর্তী সরকারের নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশের সর্বত্র গত ২২ মার্চ, ২০১৮ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার উৎসব উদযাপন করা হয়। সে দিন রাজধানী ঢাকা শহরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীকে এ উপলক্ষে সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ব্যয়বহুল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারের মন্ত্রীরা এবং পদস্থ কর্মকর্তাসহ দেশের বিশিষ্টজন ও বিদেশী দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সরকারের সব মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর ও পরিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা টি-শার্ট ও ক্যাপ পরে ব্যানার ফেস্টুনসহকারে অনুষ্ঠানটিতে যোগ দেন। জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও একই ধরনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এ অর্জনকে উদযাপন করা হয়। সে দিন কার্যত বাংলাদেশের কোথাও সরকারি ও আধাসরকারি কার্যালয়ে দিবসের অফিস সময়ের প্রারম্ভিক কিছু সময় পরবর্তী কার্যালয় সংশ্লিষ্ট কোনো দাফতরিক কাজ হয়নি। অনুষ্ঠান সংশ্লেষে ব্যবহৃত ব্যানার, ফেস্টুন, ক্যাপ, টি-শার্ট প্রভৃতির ব্যয়ভার সরকারের তহবিল থেকে মেটানো হয়। তা ছাড়া অনুষ্ঠান আয়োজনের সামগ্রিক ব্যয়ভারও সরকারের পক্ষ থেকে মেটানো হয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে চকোলেট, মিষ্টি ও বোতলজাত খাবার পানি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সে দিন আকাশ মেঘমুক্ত থাকায় রোদের তীব্রতা প্রখর ছিল এবং দীর্ঘক্ষণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ পূর্ববর্তী অপেক্ষমাণ থাকার কারণে অনেকে গরমের তীব্র জ্বালায় ঘামে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে অপেক্ষমাণ সবাই অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেননি। অনুষ্ঠানস্থলে যারা প্রবেশ করেছিলেন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে এদের অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছিল। আর এ কারণে এমন অনেকে যারা মাঝপথে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন তাদের বিফল হতে হয়েছিল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান উপভোগ করে অনেকেরই ঘরে ফিরতে মাঝরাত গড়িয়ে যায়। এমন অনেকের পরবর্তী কর্মদিবসে অফিসে আগমনে বিলম্ব ঘটলেও কর্তৃপক্ষের উদারতায় তা উপেক্ষিত হয়।
বাংলাদেশে যখন আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিকে উদযাপন করা হয়, তখন একই সময়ে অপর যে দু’টি দেশ অনুরূপ স্বীকৃতি অর্জন করেছিল তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় সরকারিভাবে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ অর্জনটি উদযাপনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উভয় দেশের গণমাধ্যমে এটিকে বড় ধরনের অর্জন হিসেবে ব্যক্ত করে কোনো ধরনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি। এর আগে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলে আমাদের দেশে এটিকে একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখে সর্বত্র সমুদ্র বিজয়োৎসব উদযাপিত হয়। আমরা যখন এটিকে বড় অর্জন হিসেবে দেখছিলাম তখন মিয়ানমার ও ভারতের পক্ষ থেকেও বিষয়টিকে নিজ নিজ দেশের বড় ধরনের অর্জন হিসেবে দেখা হয়েছে। সুতরাং স্বভাবতই প্রশ্নে সবার ক্ষেত্রে এটি অর্জন হয়ে থাকলে প্রকৃতপক্ষে কার ক্ষেত্রে বিজয় ঘটেছে?

জাতিসঙ্ঘের ওয়েবসাইটে এখনো বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশকে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে অর্জিত যোগ্যতা ধরে রাখা সাপেক্ষে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সনদ ২০২৪ সালে দেয়ার পর উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হবে। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের আগে থেকেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে পাড়ি দিয়ে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। এ দীর্ঘ পথ অতিক্রমের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া অপরিহার্য তা হলোÑ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশের পক্ষে যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিকে উপলক্ষ করে আগাম আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এটিকে উত্তরণ হিসেবে উদযাপন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই শিশুর জন্মানুষ্ঠান পালনের সমরূপ।

বাংলাদেশে যোগ্যতা অর্জনের উৎসব পালনের রেশ না কাটতেই উদযাপনের পর দিন দেখা গেল, বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানে জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করেছেÑ বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না। বিবিসিতে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’। সংস্থাটি ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত সমীক্ষায় বিশেষভাবে বাংলাদেশসহ অপর চারটি দেশ যথা লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া ও উগান্ডার বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়Ñ এ দেশগুলো এখন আর গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানছে না। এসব দেশে বহু বছর ধরেই গণতন্ত্রকে ক্ষুণœ করা হচ্ছিল। এসব দেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনটিতে।

প্রতিবেদন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর জনৈক উপদেষ্টা বিবিসি বাংলাকে প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে বলেনÑ ‘এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন’। ওই উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘গণতন্ত্রের মানদণ্ড কি আমাদের হিটলারের দেশ জার্মানির কাছ থেকে শিখতে হবে?
জার্মানি একদা হিটলার শাসিত হলেও হিটলারের বিদায়-পরবর্তী দেশটিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অক্ষুণœ রয়েছে। হিটলার স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় দেশটির শাসনকার্য পরিচালনার কারণেই দেশটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জড়িয়ে পড়ে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। পরাজয় পরবর্তী দীর্ঘ দিন জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নামে বিভাজিত থাকলেও তার অবসান ঘটেছে। এখন জার্মানি শুধু আদর্শিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্্রই নয়, এর পাশাপাশি ইউরোপের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্র।
গণতন্ত্রের মানদণ্ডের ভিত্তি হলোÑ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ। আমাদের সংবিধানের প্রাণ এর প্রস্তাবনায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উপরিউল্লিখিত লক্ষ্য অর্জনে আমরা সফল নাকি বিফল সে হিসাবটি ঠিকভাবে করতে পারলেই আমাদের অবস্থান নির্ণয় যে কারো জন্য খুবই সহজ। আর তাই বিদেশের কে কী বলল না বলল তা নিয়ে মাতামাতি না করে আমাদের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হলে আমাদের অগ্রযাত্রা কোনোভাবেই ব্যাহত হওয়ার নয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/307048