১ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ১০:২৯

বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ রাখার ঘোষণা : ব্যাংক বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া

অর্থ লোপাটে আরও উৎসাহ জোগাবে

রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে লুটপাটকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, কারণ ব্যাংকিং খাতে এখন পর্যন্ত কোনো লুটপাটকারীর বিচার হয়নি, উল্টো টাকা বের করার আরও সুযোগ দেয়া হচ্ছে -ব্যাংক বিশ্লেষকদের অভিমত * একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ, কিন্তু তিনি জেলে নন কেন? -ড. বদিউল আলম মজুমদার


সরকারি আমানতের ২৫ শতাংশ খাওয়া শেষ। এবার ৫০ শতাংশ। এরপর কত? জানতে চাইলেন ব্যাংক ও আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, যেখানে রোগীর অপারেশন প্রয়োজন সেখানে দেয়া হচ্ছে মলম। তাই এ রোগ কোনোদিন সারবে না। সংকটের উৎপত্তিতে হাত দেয়া হচ্ছে না।
এ কারণে ব্যাংক লুটেরাদের কোনো বিচার হয়নি। সীমাহীন দুর্নীতি আর ঋণ অনিয়মের কারণে বাড়ছে খেলাপি, তার শাস্তিও হয়নি। তারল্য সংকটের মূল কারণ বেপরোয়া ঋণ। সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি যে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য সরকারি আমানত তুলে নেয়া হয়েছে সেই কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচারের আওতায় এনে আজও জেলে পাঠানো হয়নি। উল্টো দেয়া হবে ৫০ শতাংশ আমানত।

কিন্তু এই আমানত যে আবার খেয়ানত করবে না সে গ্যারান্টি কে দেবে? ‘সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যাবে’ এমন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় আর্থিক খাতের কয়েকজন বিশ্লেষক শনিবার যুগান্তরের কাছে এসব অভিমত ব্যক্ত করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র ব্যাংকার যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে লুটপাটকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ ব্যাংকিং খাতে এখন পর্যন্ত কোনো লুটপাটকারীর বিচার হয়নি। উল্টো টাকা বের করার আরও সুযোগ দেয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, এর মাধ্যমে জনগণের টাকা দিয়ে ছিনিমিনি খেলার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অতীতে যারা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে জনগণের অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক প্রধান (চেয়ারম্যান), তার বিরুদ্ধে অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ, কিন্তু তিনি জেলে নন কেন? এসব অপকর্মের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিচার না করে কেন আবার সরকারি আমানতের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে, এটা আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায়। তিনি বলেন, এর আগেও দলীয় লোকদের ব্যাংকের পর্ষদে বসিয়ে লুটপাট করা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়ম নিয়ে মানুষের মনে উৎকণ্ঠা রয়েছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না। এতে ব্যাংকের সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফারমার্স ব্যাংকের কাছে জলবায়ু তহবিলের ৫০৯ কোটি টাকা আটকে আছে, দিতে পারছে না। এভাবে জনগণের অর্থ দেয়া ঠিক হবে না। তবুও মন্ত্রী যখন বলেছেন তখন দেবে। আর যদি অর্থ দিতেই হয় তাহলে আগের ২৫ শতাংশ বা তার থেকে সামান্য বেশি দেয়া যেতে পারে, তবে তা কিছুতেই ৫০ শতাংশ হতে পারে না। এছাড়া অর্থ দেয়ার আগে শর্ত দিতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ভালো ব্যাংক এবং যে অর্থ দেবে দায়-দায়িত্ব তার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সংকটের উৎপত্তি খেলাপি ঋণ, যাচাই-বাছাই ছাড়া বেপরোয়া ঋণ এবং বিচারহীনতা। এসব জায়গায় হাত দেয়া হচ্ছে না। সে কারণে উদ্যোগটির উদ্দেশ্যে সংশয় থেকে যাচ্ছে।

জানা গেছে, ব্যাংকের অনিয়ম ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে ব্যাংক রিপোর্টিং অ্যাক্ট করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ ঘটনা যদি সত্যি হয়, তবে এটি ভালো লক্ষণ নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কারও দৃশ্যমান শাস্তি হয়নি। টাকা রাখলে যাচাই-বাছাই করে রাখতে হবে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণসহ সার্বিক মান যাচাই করতে হবে। এর বাইরে যে প্রতিষ্ঠান টাকা রাখবে দায়-দায়িত্ব সে প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে।
ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ যুগান্তরকে বলেন, এ সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। ফারমার্সসহ বেসরকারি ব্যাংকে অর্থ দেয়া ঠিক হবে না।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান তারল্য সংকটের সমাধান খুঁজতে শুক্রবার রাতে ব্যাংক মালিক ও এমডিদের নিয়ে এক বৈঠকে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেয়ার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বর্তমানে সরকারি আমানতের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিধান রয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/33592