১ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ১০:২৪

বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসনের শিকার পোল্ট্রি শিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে

লোকসানের ঘানি টানতে না পেরে গত এক বছরে ২৪ হাজার পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়েছে। এতে করে বেকার হয়েছে ১৫ লাখ শ্রমিক। বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসনে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এখন অস্তিত্ব সংকটে দেশের পোল্ট্রি খামার। পোল্ট্রি নীতিমালা না থাকায় বৈষম্যের শিকার হয়ে এ শিল্পে সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। প্রতি হালি ডিম উৎপাদনে এখন লোকসান হচ্ছে প্রায় ২ টাকা। এতে করে খামার বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন প্রান্তিক এসব খামারী। এজন্য সরকারের উদাসিনতাকে দায়ী করলেন প্রান্তিক এসব খামারিরা।

এ শিল্পকে রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে পোল্ট্রি শিল্পে কৃষি সেক্টরের মতো প্রান্তিক খামারিদের সরাসরি ভুর্তকি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে এবং পোল্ট্রি খাদ্যের দাম কমাতে হবে। আর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে প্রান্তিক খামারিদের ডিম রপ্তানির সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

আধা লিটার বোতলের পানি উৎপাদন খরচ ৭ টাকা, বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ৬টাকা, পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫ সাড়ে ৫ টাকায়। খোলাবাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা। এতে করে প্রতি হালি ডিমে প্রান্তিক কৃষকের লোকসান হচ্ছে ২ থেকে ৪ টাকা। ১ কেজি ওজনের একটি মুরগির উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১২০ টাকা, তা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা। এ পরিসংখ্যান থেকে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্পে বর্তমান অবস্থার। যেখানে আধা লিটার পানি বিক্রি করে একজন বিক্রেতা সহজে ডাবল লাভ করছে সেখানে একজন ডিম কিংবা মুরগি বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। পানি বিক্রি করে একজন বিক্রেতা যে ডাবল লাভ করছে সেটা নিয়ে আমাদের কারো মাথাব্যথা নেই অথচ ডিম কিংবা কৃষিপণ্যের একটু দাম বৃদ্ধি হলে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। আজ যে পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত খামারি লাভজনক মূল্য না পেয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে দিকে কারো নজর নেই।

কয়েক মাস আগেও যে শিল্প একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিল সে পোল্ট্রি শিল্পই আজ অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। দাম কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা দেখেছি, দেশে অনেক গরিব, অল্প আয়ের লোক, বেকার শিক্ষিত যুবক ও যুব-মহিলাসহ অন্য জনগোষ্ঠী এ শিল্পের সঙ্গে নিজেদের নিয়োজিত রেখে সাফল্য লাভ করেছিল। পোল্ট্রি খামারগুলোতে অনেক বেকার যুবকরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেত। কিন্তু খামারগুলোর এ অবস্থায় বিপদে পড়েছেন অনেক বেকার যুবকরা। গত এক বছরেই বেকার হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক। তাদের অধিকাংশই যুব সমাজ। বেকার হওয়া এসব যুব সমাজ দেশের জন্য প্রচণ্ড হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কারণ তারা শুধু বেকারই হয়নি তারা বিভিন্ন এনজিও ঋণের জালে আটকে রয়েছেন। এখনও তারা কোথাও পালাতে পারছে না। এ নিয়ে তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে কথা বললেও কোন সুরহা হয়নি। ফলে সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।

বিগত পাঁচ বছরের বাজার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১২ সালে পোল্ট্রি মুরগির দাম ছিল ৯০ টাকা কেজি, পাইকারি বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি মুরগির দাম ১২০ টাকা। আর বর্তমান বাজারে ১০০টি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকা, যার দাম পাঁচ বছর আগেও ছিল ৫৮০ টাকার মধ্যে। এ হিসেবে মুরগি ও ডিমের দাম বৃদ্ধির চেয়ে পাঁচ বছরে বেশ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে পোল্ট্রি খাবারের দাম। প্রতি কেজি ভুট্টা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৩ থেকে ২৫ টাকায়। পাঁচ বছর আগে একই ভুট্টার দাম ছিল ৮ টাকা কেজি। এ হিসাবে গত পাঁচ বছরে ভুট্টার দাম বেড়েছে ৩১২ শতাংশের বেশি। মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত সয়াবিন মিলে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা কেজি দরে। পাঁচ বছর আগে একই সয়াবিন মিলে দাম ছিল কেজি ১২ টাকা। সয়াবিন মিলের দামও এ সময়ে বেড়ে গেছে ২৯১ শতাংশ। এ অবস্থায় খাবারের দাম বেড়ে গেলে একই হারে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আর সেই হারে মুরগি ও ডিমের দাম না বাড়লে লাভের পরিমাণ কমে যায়।

ব্রয়লার মুরগির একটি ডিম উৎপাদান করতে লেবার, কর্মচারী ও ক্যারিং খরচ পড়ছে ৬ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ টাকা। এক দিনের একটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দিয়ে। এই বাচ্চাকে বিক্রিযোগ্য করতে সময় লাগে ৩৫ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত। মুরগির খাদ্য ও ওষুধসহ খরচ পড়ে যায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এভাবে এক কেজি ওজনের একটি মুরগির জন্য ব্যয় হয় ১২০ টাকারও বেশি। কিন্তু বিক্রির সময় ১২০ থেকে ১৩০ টাকার বেশি তারা পান না। পাইকারী প্রতি কেজি মুরগী বিক্রি হচ্ছে ১১০ -১২০ টাকায় এতে অনেকে আবার খামার ভাড়া দিচ্ছেন।

এমন অবস্থার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে বিদেশি তথা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। পোল্ট্রি খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলো সঙ্গে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক স্বল্প পুঁজির দেশি খামারিরা তাদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছে। ভারতের গোদরেজ, টাটা ও অমৃত গ্রুপসহ ৭টি কোম্পানি একদিন বয়সী বাচ্চা উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্রয়লার মুরগি পালন, ডিম উৎপাদন, ফিড তৈরি এমনকি বিদেশ থেকে ওষুধ এনে বাজারজাত পর্যন্ত করছে।

এভাবে তারা বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে এবং সুযোগ বুঝে অভ্যন্তরীণ বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। ইতোমধ্যে পোল্ট্রি শিল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ বাজার বিদেশিরা দখল করে নিয়েছে। যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। সারা পৃথিবী যখন নিজেদের শিল্পকে রক্ষার জন্য নানান নীতিমালা তৈরি করছে তখন আমাদের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কী করছে?
আমাদের ভাবতে হবে এ পোল্ট্রি শিল্পের কারণে আমরা সহজেই আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারছি। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, স্কুলের টিফিন, রোগীদের পথ্য থেকে শুরু করে মজাদার আধুনিক রেসিপিতে পোল্ট্রির মাংস আজ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খাদ্য হিসেবে নিয়মিত তালিকায় উঠে আসছে পোল্ট্রির ডিম। তৈরি পোশাক খাতের পর দেশে বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে যে শিল্পটি তার নামও পোল্ট্রি শিল্প।

মেডিকেল সায়েন্স মতে, বাংলাদেশের পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শারীরিক গঠন অনুযায়ী প্রতিদিন ১২০ গ্রাম মাংস খাওয়া প্রয়োজন। অথচ দেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন মাংস পাচ্ছে মাত্র ২১ গ্রাম। একইভাবে একজন মানুষের বছরে ১০৪টি ডিম খাওয়া দরকার। সেখানে প্রতি বছর গড়ে একজন মানুষের ডিম খাওয়া হচ্ছে ৫০টি। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন, চর্বি, জিংকসহ নানা উপাদানে সমৃদ্ধ পোল্ট্রির মাংস ও ডিমের মতো প্রাণিজ আমিষ খাওয়ার দিক থেকে এভাবেই পিছিয়ে আছে দেশের মানুষ। জনস্বাস্থ্যের এত বড় সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে যে খাত দেশের সেই পোল্ট্রি শিল্পই আছে সংকটে। এ দিকে বিগত বছরের তুলনায় কমেছে মুরগি এবং ডিমের দাম। তবে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় খামার বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক খামারি।
ব্রিডার্স এসোসিয়েশন সূত্র জানিয়েছে, এক মানুষের বছরে ১০৪ টি ডিম খাওয়ার দরকার। আমাদের দেশের একজন মানুষ বছরে ৮২ টি খেযে থাকে। আর বছরে ৮৬ টি ডিম মাথা পিছু উৎপাদন হচ্ছে। এতে করে মাথা পিছু ৪ টি ডিম অতিরিক্ত উৎপাদন হচ্ছে। অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে ডিমের দাম পাচ্ছে না কৃষকরা।

ডিম উৎপাদনে যেমন জনগনকে উৎসাহিত করা দরকার তেমনি উৎপাদন পর্যায়ে প্রান্তিক খামারিকে ভর্তুকি দেয়া উচিৎ। তা না হলে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বন্ধে হয়ে যাবে বাকি খামারও।
পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মহসিন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন,পোল্ট্রি শিল্পে এত খারাপ অবস্থা আর কখনও দেখা যায়নি। গত এক বছরেই বন্ধ হয়েছে ২৪ হাজার খামার। এতে ্েবকার হয়েছে ১৫ লাখ যুবক। এ নিয়ে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই।
তিনি আরও বলেন,উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় পলিসি না থাকার কারনে ই দেশে এই অসমতা দেখা দিয়েছে। বড় খামার আরও বড় হলেও ছোট খামার প্রতি দিনই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক ঋন পাওয়া যাচ্ছে না। উচ্চ সুদে এনজিওগুলো থেকে ঋন নিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারছে না। লোকসানের ঘানি টেনে খামার বন্ধ করলেও ঋণের জালে আটকা রয়েছে তাদের অনেকেই।
তিনি আরও বলেন,সরকার ২০০৮ সালে পোল্ট্রি নীতি মালা করলেও এখনও তারা কার্যকর হয়নি। এটি এখনও আতুঁর ঘরেই রয়ে গেছে। সরকার যদি বহু জাতি কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ হয় তাহলে পোল্ট্রি শিল্প শতভাগ বিদেশিদের হাতে চলে যাবে। এখনও দেশের ৬০ ভাগ ব্যবসা বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। আর বাচ্চা উৎপাদনে এখনও ৮০ ভাগ বিদেশিদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। এনিয়ে সরকারকে এখনই ভাবতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংস হলে ৫০ লাখ মানুষ বেকার ও পরোক্ষভাবে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ পথে বসার উপক্রম হবে। তাই এ শিল্পকে রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে পোল্ট্রি শিল্পে কৃষি সেক্টরের মতো প্রান্তিক খামারিদের সরাসরি ভুর্তকি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে এবং পোল্ট্রি খাদ্যের দাম কমাতে হবে। আর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে দেশের প্রান্তিক খামারিদের ডিম রপ্তানির সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/324795