৩১ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৮:২২

প্রশ্নফাঁস আতঙ্কে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক

আগামী সোমবার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে এইচএসসি, আলিম ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা। আর বর্তমানে পরীক্ষা মানেই প্রশ্নফাঁস। গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক প্রায় সব পাবলিক পরীক্ষায় অবিরাম প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এটাই এখন যেন প্রতিষ্ঠিত সত্য পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে।

অনেক পরীক্ষার্থী অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সাথে কথা বলে প্রশ্নফাঁসের বহুমাত্রিক প্রভাবের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। প্রশ্নফাঁসের আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করছেন লাখ লাখ এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা। অনেকে ভুগছেন মারাত্মক রকমের হতাশা আর অস্থিরতায়। অনেকে ভুগছেন বিষণœতায়। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী হারিয়েছে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আর মনোযোগ। আবার অনেক শিক্ষার্থী ধান্ধায় রয়েছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিভাবে সংগ্রহ করা যায় সে বিষয়ে। অনেক কলেজের শিক্ষকেরা জানিয়েছেন প্রশ্নফাঁসের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনার প্রতি খুবই ড্যামকেয়ার ভাব। অনেকের বিশ্বাস প্রশ্নফাঁস হবেই এবং তারা কোনো না কোনোভাবে সে প্রশ্ন সংগ্রহ করতে পারবে। ফলে তারা নিয়মিত ক্লাসে যেমন আসে না তেমনি পড়ালেখাও করে না ঠিকমতো। সারা বছর নানা ধরনের আডডাবাজি, ফেসবুক ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করাসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ড করে তারা সময় পার করে; কিন্তু পড়ালেখার প্রতি তাদের মনোযোগ নেই। অনেকে পরীক্ষার আগে হন্যে হয়ে চেষ্টা করে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিভাবে সংগ্রহ করা যায় সে ব্যাপারে।

অনেক শিক্ষক ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, এ অবস্থা আর চলতে পারে না। এটি বন্ধ করা না গেলে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়বে। মুখ থুবড়ে পড়বে। শিক্ষা বলতে আসলে আর কিছু থাকবে না। যেকোনো মূল্যে কঠোর হস্তে এটা দমন করা দরকার অবিলম্বে।
প্রশ্নফাঁস রোধে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেছে বারবার অগ্রিম ঘোষণা দিয়ে। ইন্টারনেটে অগ্রিম ঘোষণা সত্ত্বেও প্রশ্নফাঁস রোধে ব্যর্থতায় এটা এখন এক প্রকার বদ্ধমূল ধারণা অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে যে, প্রশ্নফাঁস হবেই। এরইমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো: সোহরাব হোসাইন গত ২৫ মার্চ বলেছেন, প্রশ্নফাঁস রোধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে; কিন্তু তারপরও বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রশ্নফাঁস হবে না তার শতভাগ নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। ফলে প্রশ্নফাঁস নিয়ে আতঙ্ক আর অস্থিরতা দূর হচ্ছে না কোনোমতেই।

গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শুরুর অনেক আগে থেকেই লাখ লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা প্রশ্নফাঁস আতঙ্ক আর অস্থিরতার মধ্যে দিন পার করতে থাকেন। অবশেষে তাদের সব আশঙ্কা সত্য হিসেবেই প্রমাণিত হয় পরীক্ষা শুরু দিনই। প্রশ্নফাঁসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ পরীক্ষা এবং টানা ১১ দিন পর্যন্ত ঘটে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা। ১৭ দিনে মোট ১২টি বিষয়ের প্রশ্নফাঁস হয়। বিরতিহীন প্রশ্নফাঁসের কারণে পাবলিক পরীক্ষা পরিণত হয় একটি তামাশায়। সারা দেশে এ নিয়ে বিরাজ করে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা।
ফাঁস হওয়া প্রায় প্রতিটি প্রশ্নের সাথে হুবহু মিল ধরা পড়ে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নের। এ মর্মে তখন প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এসএসসি পরীক্ষায় একের পর এক প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন করে যাচাই কমিটি। তদন্তে যাচাই কমিটি প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পায়। একটি বিষয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে হুবহু মিল পাওয়া গেছে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নের। এ ছাড়া অন্য বিষয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে আংশিক মিল পেয়েছে কমিটি।

পুরোপুরি ফাঁস হওয়া প্রশ্নসহ আংশিক ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা বাতিলের সুপারিশ করা হবে কমিটির পক্ষ থেকে এমনটি বলা হলেও পরে আর এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ নিয়েও ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। অনেক অভিভাবক ও শিক্ষকের মতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা বাতিল করলে তা প্রশ্নফাঁস রোধে একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারত। তাদের মতে পরীক্ষা বাতিল করা হলে প্রশ্নফাঁসকারী ও ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সংগ্রহকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলত। কারণ তখন তারা বুঝতে পারত যে, প্রশ্নফাঁসের ঘটনা জানাজানি হলে আর তদন্তে প্রমাণিত হলে পরীক্ষা বাতিল করা হবে। কাজেই প্রশ্নফাঁস করে আর ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সংগ্রহ করে লাভ নেই।
কিন্তু নানা অজুহাতের কথা বলে প্রশ্নফাঁস রোধে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে অপরাধীরা ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা জানে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা জানাজানি হলেও কোনো সমস্যা নেই। পরীক্ষা বাতিল হবে না। আর পরীক্ষার্থীরাও এটা নিশ্চিত হওয়ায় তারাও বুঝে গেছে যে করেই হোক প্রশ্ন সংগ্রহ করতে পারলেই সাফল্য নিশ্চিত।
অনেকে অভিযোগ করেছেন প্রশ্নফাঁসের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পরও সে পরীক্ষা বাতিল না করে বরং সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনাকে একপ্রকার প্রশ্রয় এবং বৈধতা দেয়া হচ্ছে। তবে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীসহ অনেকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা স্বীকার করলেও একটা সময় পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা স্বীকারই করা হতো না। এটাকেও প্রশ্নফাঁসের ঘটনাকে প্রশ্রয় দেয়ার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন অনেক শিক্ষক অভিভাবক।

কয়েক বছর ধরে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিবারই ঘটনা অস্বীকার করা হয়েছে। এমনকি প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় অনেককে গ্রেফতার এবং তদন্তে অনেক ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পরও অস্বীকার করা হয়েছে। অবশেষে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ স্বীকার করেছেন শিক্ষামন্ত্রীসহ অনেকে।
এবার মোট ১৩ লাখ ১১ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় শিক্ষাব্যবস্থার নৈরাজ্যের পাশপাশি আরেকটি দিক জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। তা হলো মানুষের নৈতিক অধঃপতনের চিত্র। কারণ সমাপনীসহ বিভিন্ন পরীক্ষার সময় দেখা গেছে সন্তানের জন্য ছুটছেন অনেক অভিভাবক ফাঁস হওয়া প্রশ্ন জোগাড়ের জন্য। এ ছাড়া প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় বারবার গ্রেফতার হয়েছেন জড়িত অনেক শিক্ষক। গত এসএসসি পরীক্ষার সময়ও গ্রেফতার হয়েছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নসহ বিপুল শিক্ষার্থী। এ কুকর্মে রয়েছেন অনেক শিক্ষকও।
বিরামহীন প্রশ্নফাঁসের কারণে এখন পরীক্ষা এলেই হতাশায় ভেঙে পড়েন মেধাবী শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকেরা। কারণ সারা বছর কঠোর অধ্যয়ন করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার পর যদি প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে তবে তাদের দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না আর কোথাও। পরীক্ষা এলেই তাই হতাশা আর বেদনায় ভেঙে পড়েন তারা। অনেক শিক্ষার্থী ধরে রাখতে পারছেন না কান্না। অন্য দিকে সারা বছর তেমন পড়াশোনা না করে, ক্লাসে হাজির না হয়েও ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করছেন অনেকে। এ অবস্থা মেধাবীদের জন্য ভীষণ পীড়াদায়ক। অনেক অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশেরও ভাষা খুুঁজে পাচ্ছেন না। অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন ক্রমাগত প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন তাদের মেধাবী আর পড়–য়া সন্তানরা।
গত এসএসসি পরীক্ষার সময় অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন তাদের সন্তানরা তাদের চার পাশের প্রায় সব শিক্ষার্থীর মুখে মুখে শুনছে আর জানতে পারছে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা। পরিচিত কোনো কোনো সহপাঠীই তাদের সন্তানদেরও ফাঁস হওয়া প্রশ্ন অফার করছে বলেও জানিয়েছেন কোনো কোনো অভিভাবক।

শিক্ষার মান, প্রশ্নফাঁস ছাড়াও গত কয়েক বছরে বারবার শিক্ষার্থী অভিভাবকদের সীমাহীন ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে সৃজনশীলসহ নানা ধরনের শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের কারণে। তা ছাড়া অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস উঠেছে ঘনঘন পাবলিক পরীক্ষা চালুর ফলে। আগে যেখানে এইচএসসি পাস করতে দুইটি পাবলিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হতো সেখানে এখন চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। যেসব পরিবারে একাধিক সন্তান লেখাপড়া করছে সেসব অভিভাবকের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই সন্তানদের পরীক্ষাকেন্দ্রিক ব্যস্ততা সামলাতে। শহরের অনেক নারী অভিভাবক জানিয়েছেন ঘনঘন পরীক্ষা আর সন্তানদের পড়াশোনাকেন্দ্রিক ব্যস্ততার কারণে তাদের আর সংসারজীবন, ধর্মকর্ম বলতে কিছু নেই। অনেকে যেন আর কুলাতে পারছেন না। অনেকে কাতর সুরে বলেছেন পঞ্চম ও অষ্টমে পাবলিক পরীক্ষা যদি তুলে দিতো তাহলে আমরা বাঁচতাম।
গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় টানা প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনা এর আগে যে ঘটেনি তা নয়।
২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৪ সাল ছিল পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের হিড়িকের বছর। ২০১৪ সালে বছরজুড়ে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় ঘটতে থাকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা। সমাপনী, এএসএসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি বিষয়ে মুড়ি মুড়–কির মতো মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। এ ছাড়া ওই বছর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষায়ও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/306314