৩১ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৮:১৪

শুভঙ্করের অর্থনীতি ও আমাদের গন্তব্য

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

গত বছরের গোড়ার দিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, কিছু দিনের মধ্যে দেশের কিছু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে। অর্থমন্ত্রীর এমন মন্তব্য আমাদের দেশের অর্থনীতির ভয়াবহ রূপই ফুটে ওঠে। এখন বাস্তবে তার প্রতিফলনও খুবই স্পষ্ট। কিছুদিন আগেও ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার স্তূপ লক্ষ করা গেলেও এখন সে অবস্থাও আর নেই। এখন দেশের ব্যাংকগুলো বেশ অর্থসঙ্কটে পড়েছে। কিছু দিন আগে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, দেশের ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের চেকের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে আমানতকারীরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানানো হয়েছে; কিন্তু সংশ্লিষ্টদের ঢাকঢোল পেটানো কিন্তু বন্ধ নেই। তারা দাবি করছেন দেশের অর্থনীতি মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আছে। আসলে দেশ শুভঙ্করের অর্থনীতির কবলে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

পরিস্থিতি যে ক্রমেই খারাপের দিকেই যাচ্ছে এ বিষয়ে সচেতনমহল প্রায় একমত। এখন অর্থনীতিবিদেরা ব্যাংকে তারল্য সঙ্কটের কথা ঘুরেফিরে শোনাচ্ছেন। ব্যাংকে পর্যাপ্ত অর্থ মজুদ থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে না এমন কথাও শোনা গিয়েছিল কিছুদিন আগেই; কিন্তু কথার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। চাহিদা থাকলেও অর্থসঙ্কটের কারণেই ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারছে না, এমন কথাই এখন বাজারে চাউর হতে শোনা যাচ্ছে। যা আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসঙ্কেতই বলতে হবে।

মূলত সীমাহীন নৈরাজ্যের কারণেই অর্থনীতিতে মন্দাভাবটা কাটিয়ে ওঠা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। অর্থনীতিতে এই গুমোট ভাবটা স্থায়ী রূপ লাভ করলেও গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে তার ছিটেফোঁটা। তাই দেশের মানুষ বাস্তব অবস্থাটাও উপলব্ধি করতে পারছে না। জাতীয় অর্থনীতিতে সীমাহীন নৈরাজ্যের প্রেক্ষাপটেই শেয়ারবাজার বন্ধ্যত্ব চলছে বেশ আগে থেকেই। রেমিট্যান্স কমেছে আশঙ্কাজনক হারে, দেশের গার্মেন্ট শিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কুঋণ ও ঋণখেলাপির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোসহ সব ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
এ ছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশী বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। দেশে আমদানি বেড়েছে, কমেছে রফতানির হার। দেশের অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। কৃষি উৎপাদন কমেছে, কৃষক যা উৎপাদন করে তারও ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কৃষকেরা বাণিজ্যিক কৃষিতে আগ্রহ হারাতে বসেছেন। সঙ্গতকারণেই সার্বিক উৎপাদন কমেছে। বিদেশী পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।

দেশের অর্থনীতিতে নৈরাজ্য ও লোপাট শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। সে ধারাবাহিকতায় দেশের শেয়ার মার্কেট থেকে লাখ-কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, নৈরাজ্যবাদীদের কাছে আমরা কতটা অসহায়। অপর দিকে, গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে ব্যাংক খাতে সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা। দেশের অধঃস্তন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নির্দেশনা না মেনে খেয়ালখুশি মতো ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যা দেশের অর্থনীতিকে আরো অশান্ত ও অস্থির করে তুলেছে এবং আমানতকারীরা ব্যাংক খাতের ওপর আগ্রহ ও আস্থা হারাতে শুরু করেছেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ‘ঋণ আমানতের সুদের ব্যবধান (স্প্রেড) কোনোক্রমেই পাঁচ শতাংশের ওপরে হওয়া যাবে না’ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দীর্ঘ দিন ধরেই এ নির্দেশনা দিয়ে আসছে; কিন্তু কিছু ব্যাংক বরাবরই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা অমান্য করে আসছে এবং এখনো তা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করে সাত ব্যাংক তাদের ঋণ আমানতের সুদ হারের ব্যবধান সাড়ে পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ আট শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে পাঁচটিই বিদেশী। দু’টি স্থানীয় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক।

মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ আমানতের সুদ হারের ব্যবধান পাঁচ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে বরাবরই ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়; কিন্তু বরাবরই কিছু ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা অমান্য করে থাকে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও যেন করার কিছু নেই।
ঋণ আমানতের সুদহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক সামগ্রিকভাবে গড়ে এক দশমিক ২৬ শতাংশ হারে আমানত সংগ্রহ করেছে; কিন্তু গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ দিয়ে গড়ে সুদ আদায় করেছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ হারে। এখানে ব্যাংকটির ৩১ জানুয়ারিতে স্প্রেড ছিল ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে পাঁচ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করতে এক টাকারও কম খরচ পড়ে সিটি ব্যাংক এনএ ও উরি ব্যাংকের।

যেমনÑ সিটি ব্যাংক এনএর ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করতে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৩৯ পয়সা, ব্যাংকটির স্প্রেড হলো পাঁচ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অন্য দিকে উরি ব্যাংকের ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৯৮ পয়সা, যেখানে ব্যাংকটির স্প্রেড ছয় দশমিক ৮৭ শতাংশ। আরেকটি বিদেশী ব্যাংক এইচএসবিসির গড় আমানত সংগ্রহের ব্যয় এক দশমিক ৩৭ শতাংশ, অথচ ব্যাংকটির স্প্রেড পাঁচ দশমিক ৯১ শতাংশ। অন্য দিকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গড় আমানত ব্যয় দুই দশমিক ৭২ শতাংশ, অথচ ব্যাংকটির স্প্রেড পাঁচ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
বিদেশী পাঁচ ব্যাংকের মতো বেপরোয়া ব্যাংকিং করছে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। ব্র্যাক ব্যাংকের গড় আমানত ব্যয় চার দশমিক ৩১ শতাংশ, যেখানে ঋণের গড় সুদ হার ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ফলে ব্যাংকটির স্প্রেড রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি অর্থাৎ সাত দশমিক ৩৫ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের গড় আমানত ব্যয় দুই দশমিক ২৭ শতাংশ, যেখানে ব্যাংকটির স্প্রেড ছয় দশমিক ৫৯ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানলে কমে সুদে ঋণ বিতরণ করা যেত।

যথাযথ তদারকির অভাব ও রাজলুটেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দেশের অর্থনৈতিক সেক্টর সীমাহীন নৈরাজ্য ও অস্থিরতা চলছে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণেই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও আস্থাহীনতার কারণেই তাদের বিনিয়োগ অন্য দিকে সরিয়ে নিচ্ছেন। ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থাপনার কারণেই ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হওয়ার পরিবর্তে ক্রমে সঙ্কোচিত হয়ে আসছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহেও পড়েছে রীতিমতো ভাটির টান। ফলে সার্বিক বিবেচনায় দেশের অর্থনীতি এখন এক মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

সর্বপরি দেশের ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও নৈরাজ্য পরিস্থিতিকে আরো জটিল হতে জটিলতর করে তুলেছে। এমনকি খেলাপি ঋণের চাপ বহন করাও আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে; কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এসব কথা মানতে চান না বরং দেশের অর্থনীতি অন্য সব সময়ের চেয়ে ভালো পর্যায়ে আছে বলে দাবি করা হচ্ছে; কিন্তু আমরা এই শুভঙ্করের অর্থনীতি দিয়ে দেশ ও জাতিকে কতখানি এগিয়ে নিতে পারব, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
smmjoy@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/306174