আশুগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চরসোনারামপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে আশুগঞ্জ-ভৈরব মেঘনা সেতু থেকে কুলিয়ারচর পর্যন্ত ডুবোচর খনন কাজের আড়ালে চলছে অবৈধ বালু ব্যবসা
৩০ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ১০:১১

‘ফাও’ বালুর ব্যবসা রমরমা

নদী খনন হচ্ছে সরকারি টাকায়। উত্তোলন হওয়া বালু যাচ্ছে সিন্ডিকেটের গোলায়। মজুদ হচ্ছে রেলওয়ের জায়গায়। আর এই থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। ‘ফাও’ বালুর রমরমা ব্যবসার ৫০ জনের দলে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, রেলওয়ে কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছে ব্যবস্থা নিতে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্টদের পত্র দেয়া হয়েছে। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মকর্তারা বলছে বালু বিক্রি বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।

জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চর-সোনারামপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে পানি উন্নয়নে বোর্ডের অধীনে আশুগঞ্জ-ভৈরব মেঘনা সেতু থেকে কুলিয়ারচর পর্যন্ত ডুবচর খনন কাজ শুরু হয়েছে মার্চ মাসের শুরুতে। তার আগেই বালু ব্যবসার সব বন্দোবস্ত পাকাপাকি হয়। বালু ব্যবসার দলে রয়েছে এমন একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, নরসিংদী জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন কর্মকর্তার নিয়োজিত স্থানীয় এজেন্ট জাকির হোসেন আশুগঞ্জে বালু বিক্রির সব ঠিকঠাক করেছেন। বালুর দাম গ্রহণ করেন জাকির হোসেন নিজেই। বুধবার সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে গা-ঢাকা দেন জাকির হোসেন। তার ব্যবহৃত মুঠোফোন কিংবা অবস্থান সম্পর্কে কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। ওই জায়গায় এবার নদী খননে ৬-৭ কোটি ঘনফুট বালু উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতি ফুট বালুর মূল্য ধরা হয়েছে ২ টাকা। সেই হিসেবে বিনা পুঁজির এই ব্যবসায় ১৩-১৪ কোটি টাকা পকেটে ঢুকবে সিন্ডিকেট সদস্যদের। এদিকে এই বালু মজুদ করা হচ্ছে আশুগঞ্জ রেল সেতুর কাছে খাদ্য গুদাম সাইলোর পাশে রেলের নিজস্ব বিশাল জায়গাজুড়ে। জায়গাটি কৃষি কাজের নামে বন্দোবস্ত এনে বালু মজুদের কাজে ব্যবহার করছেন বন্দোবস্ত গ্রহণকারীরা। তাদেরকেও বালু ব্যবসার দলে রাখা হয়েছে। বালুর বিশাল স্তূপ আর বালু বোঝাই ট্রাকের চলাচলের কারণে মেঘনা নদীর পূর্বতীর, আশুগঞ্জ খাদ্য গুদাম (সাইলো), মেঘনা নদীতে দুইটি রেলসেতু এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু হুমকির মুখে পড়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বালু মজুদ করার জন্য এস্কেভেটর ও পে-লোডার দিয়ে মাটি খনন করে পাড় নির্মাণের কাজ শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালী ওই সিন্ডিকেট। এরপর রেলওয়ের সহকারী এস্টেট অফিসার, ফিল্ড কানুনগো ও সার্ভেয়ার সেখানে এসে বাধা দেন। চলতি মাসের ১ মার্চ পানি উন্নয়ন বোর্ডে সংশ্লিষ্ট জেলার কর্মকর্তাকে রেলওয়ের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম পাটোয়ারী একটি চিঠি দিয়ে অবৈধভাবে ওই জায়গায় প্রবেশ করে মাটি ভরাটের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন। কিন্তু এই বাধা অগ্রাহ্য করেই সেখানে বালুর স্তূপ করে রমরমা ব্যবসা চালানো হচ্ছে। রেলওয়ে থেকে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহায়তা চাওয়া হয় সেখানে বালুর মজুদ বন্ধে। এই চিঠি পাওয়ার পর সহায়তার পরিবর্তে স্থানীয় চরচারতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আশুগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জিয়াউদ্দিন খন্দকার নিজেই বালুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনিই এখন বালু ব্যবসায়ী দলের প্রধান।

কৃষি কাজের জন্য বন্দোবস্ত গ্রহণকারীদের একজন সামসুল হক মুন্সী জানান, রেলের জায়গা বন্দোবস্ত এনেছি আমরা কয়েকজন। কিন্তু আমি বালুর ব্যবসাতে নেই। তিনি আরও জানান, স্থানীয় চরচাতলা ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউদ্দিন খন্দকার এই বালুর ব্যবসা করছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন মাসুদ মেম্বার, দীন ইসলাম মেম্বার, মজিবুরসহ ৩০-৪০ জন। আমি শুনেছি ভাগাভাগির হিসেবে চেয়ারম্যান নিজে ৫৫ পয়সা এবং বাকিদের প্রদান করছেন ৪৫ পয়সা।
তবে অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউদ্দিন খন্দকার জানান, নদী খনন করে বালু কোথাও না কোথাও রাখতে হয়। আমরা আলোচনা করে এখানে বালু রাখার ব্যবস্থা করেছি। এ জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড রেলওয়ের কাছ থেকে মৌখিকভাবে লিখিত অনুমতি নিয়েছে। তারা আমাদের কাছে কোনো বালু বিক্রি করছে না। আমরাও ব্যবসা করছি না।
আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বদরুল আলম তালুকদার জানান, এই ব্যাপারে রেলওয়ের কোনো চিঠি তিনি পাননি। দিলেও হয়তো তারা অনুলিপি দিয়েছে। অ্যাকশনের জন্য বলেনি।
কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শামছুর রহমান মুঠোফোনে যুগান্তরকে অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, বালু বিক্রি বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এছাড়া জাকির হোসেন নামে কাউকে তিনি চিনেন বলে দাবি করেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম পাটোয়ারী যুগান্তরকে জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে পত্র ও মৌখিকভাবে একাধিকবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা আমাদেরকে কোনো জবাব দেয়নি আজ পর্যন্ত। কোনো জবাব না পেলে রেলওয়ে বিষয়টি আইনগতভাবে দেখবে। এছাড়া রেলওয়ে কোনো কর্মকর্তা জড়িত না বলে তিনি দাবি করেন।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/33064