৩০ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ১০:০৯

বিআইবিএমের কর্মশালায় বক্তারা

ব্যাংকের অনিয়ম চাপা পড়ছে ম্যানেজমেন্টের হস্তক্ষেপে

অডিটের অনেক কিছুই রিপোর্টে প্রকাশ পায় না। আবার বোর্ড ও টপ ম্যানেজমেন্টের ইচ্ছেমতো নির্দোষ ব্যক্তিকেও দোষী করে রিপোর্ট করা হয়। এভাবেই পরিচালনা বোর্ড ও টপ ম্যানেজমেন্টের হস্তক্ষেপে ব্যাংকের অনেক অনিয়ম চাপা পড়ে যায়। যেখানে তদন্ত (অডিট) কর্মকর্তাদের কোনো ক্ষমতাই থাকে না। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে ‘ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স অব ব্যাংকস’ শীর্ষক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং বিআইবিএম নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। বক্তব্য রাখেন ঢাকা ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি, এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মেহমুদ হোসেন এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএফএম শরিফুল ইসলাম।
বক্তারা বলেন, টপ ম্যানেজমেন্টের ইচ্ছার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। এজন্য আইসিসিডি (ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট) স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। অডিট কর্মকর্তাদের তদন্তে অনেক বিষয় উঠে এলেও তা তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একা কিছুই করতে পারবে না। তাই সরকার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

ডেপুটি গভর্নর বলেন, টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৩ সালে কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে একটি গাইডলাইন করেছিল, যা এখন প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা প্রতিনিয়তই উন্নত করা হচ্ছে। পাশাপাশি অনলাইন মনিটরিংও করা হচ্ছে।
কর্মশালায় ঢাকা ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং সাম্প্রতিক ফরমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে যেসব দুর্নীতি এবং অনিয়ম হয়েছে, তার প্রধান কারণ হচ্ছে সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতি। এক্ষেত্রে ব্যাংকের আইসিসি বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি বলেন, কমপ্লায়েন্স এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে ব্যাংকিং খাতের এ দুরবস্থা। ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে পরিচালনা বোর্ড, ম্যানেজমেন্ট এবং শাখা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে সৎ, যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রয়োজন।

কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলি ব্যাংক পরিচালকদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, এখন যদি বলা হয়, পরিচালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে, তাহলে ব্যাপক হৈ চৈ পড়ে যাবে। কিন্তু এটা করা উচিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে ভাবতে হবে। যেকোনোভাবে পরিচালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে ভূমিকা রাখতে হবে। আইসিসিডিতে কাজ করার জন্য কর্মকর্তাদের আলাদাভাবে ইনসেনটিভ দিতে হবে।

ইয়াছিন আলির বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, আমিও এটা মনে করি, ব্যাংকের পরিচালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটা খুবই প্রয়োজন।
এনআরবি ব্যাংকের এমডি মেহমুদ হোসেন বলেন, সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এবং পরিচালনা বোর্ড ঠিক হলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এখানে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এবং পরিচালনা বোর্ডের (টোন অব দ্য টক) কথার ভাষা বুঝতে হবে। অডিট কমিটি এবং সিনিয়র ম্যানেজমেন্টকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, বছর শেষে ব্যাংকগুলো যে মুনাফা বাড়ানোর চিন্তায় থাকে বা মুনাফার টার্গেট করা হয়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা ব্যাংকিং বিজনেস হল জেনারেশন বিজনেস। এটা শর্ট টাইম বিজনেস নয়। বছর শেষে মুনাফা বাড়াতে গিয়ে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং কমপ্লায়েন্স রক্ষা করতে পারে না ব্যাংকগুলো।

ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক এমডি এএফএম শরিফুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের প্রধান ঝুঁকিই হল (ক্রেডিট রিস্ক) ঋণ ঝুঁকি। আইসিসিডিতে মেধাবী কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া কর্মকর্তারা এ বিভাগে কাজ করতে যাতে আগ্রহী হয়, সেজন্য তাদের ইনসেনটিভ দিতে হবে।
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বিআইবিএমের অধ্যাপক এবং পরিচালক মো. মহিউদ্দিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোতে বেশিরভাগ কর্মকর্তাই আইসিসি বিভাগে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে। শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ কর্মকর্তার প্রথম পছন্দ এ বিভাগ। এছাড়া বিভাগটিতে যারা কাজ করেন তাদের অন্য কাজও করতে হয়। এ বিভাগের কর্মকর্তাদের অনেক সময় ব্যবসার লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হয়। এছাড়া অনিয়ম শনাক্ত করার পর তা ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। ছেড়ে না দিলে বদলি, পদোন্নতি বন্ধসহ নানাভাবে অপমান করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র একটি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী। এছাড়া ১৮টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সন্তোষজনক, মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে ২৬টি ব্যাংকে, কোনোমতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে ১০টি ব্যাংকে এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অসন্তোষজনক একটি ব্যাংকে। দেশের সরকারি, বেসরকারি এবং বিদেশি ব্যাংক মিলিয়ে ৩৪টি ব্যাংকের ওপর গবেষণা করা হয়েছে।
কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিআইবিএমের মুজাফফর আহমেদ চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত এ খোদা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/33063