২৯ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:২৪

জমির মূল্য বৈষম্যে বাড়ছে কালো টাকা

জমির বাজার মূল্যে বৈষম্য এবং অসামঞ্জস্যতায় বাড়ছে কালো টাকা। সারাদেশের প্রতিটি মৌজার ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির জমির মূল্য পার্থক্য থাকলেও ওইসব জমির নির্ধারিত বাজার মূল্য (মৌজা মূল্য) অভিন্ন। তাতে উন্নত শ্রেণির বেশি মূল্যের ও অনুন্নত শ্রেণির কম মূল্যের জমি ক্রেতাদের অভিন্ন বাজার মূল্যের ওপর রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হচ্ছে। এতে কম মূল্যের জমি ক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ বাড়তি খরচ হচ্ছে। এ নিয়ে সারাদেশে চলছে অস্থিরতাও।

অন্যদিকে অতি মূল্যবান জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্য গোপন করা হচ্ছে। এতে জমি বিক্রেতারা কালো টাকার মালিক হচ্ছেন। একই সঙ্গে জমিতে বিনিয়োগকৃত ক্রেতার বাড়তি অর্থ অপ্রদর্শিত থেকে যাচ্ছে। সেটা হয়ে যাচ্ছে কালো টাকা। এটাকে কালো টাকার অন্যতম উৎস্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

দেশের সব স্থানের উন্নত শ্রেণির বেশি মূল্যের ও নিম্ন শ্রেণির কম মূল্যের জমির মৌজা মূল্য হার নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধান ও মূল্য সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে মৌজাকে গুচ্ছ গুচ্ছ (ক্লাস্টার) করে নতুন বাজার মূল্য হার নির্ধারণের কথা ভাবা হচ্ছে। উন্নত শ্রেণির জমির মধ্যে রয়েছে শিল্প, বাণিজ্যিক, আবাসিক ইত্যাদি। অনুন্নত শ্রেণির মধ্যে রয়েছে নাল, ডোবা, কৃষি ইত্যাদি।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সমকালকে বলেন, জমির মূল্যই কালো টাকার অন্যতম উৎস্য। জমি বেচা-কেনায় প্রকৃত মূল্য প্রতিফলিত হচ্ছে না। শহর, বন্দর, নগরের অতি মূল্যবান জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় জমির মোট মূল্যের বড় একটি অংশ গোপন করা হচ্ছে। গোপনকৃত ওই টাকাই কালো টাকা। কালো টাকার এই উৎস বন্ধে জমির বাজার মূল্য নির্ধারণে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে জানান, বিষয়টি তিনি এবং অর্থমন্ত্রী দেখছেন। এ নিয়ে তাদের দু'জনের আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। জমির বাজার মূল্যে অসামঞ্জস্যতা দূর করতে তারা চেষ্টা করছেন। জমির বিদ্যমান মূল্য বৈষম্য দূর করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, অবশ্যই মৌজাভিত্তিক জমির মূল্যে সামঞ্জস্যতা আনা হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জমির নির্ধারিত বাজার মূল্য প্রত্যাহার করা হলে রেজিস্ট্রেশনের সময় সংশ্নিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রাররা বিদ্যমান মূল্য যাচাই করার সুযোগ পাবেন। তাতে জমির প্রকৃত মূল্য প্রতিফলিত হবে। এতে একদিকে কালো টাকার উৎস বন্ধ হবে, অন্যদিকে এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়ে যাবে।

এদিকে আইন মন্ত্রণালয় অন্য ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, বাজার মূল্য প্রত্যাহার করা হলে ক্রেতা-বিক্রেতারা যোগসাজশে প্রচলিত বাজার মূল্যের চেয়ে কম দর উল্লেখ করে রেজিস্ট্রেশন করাতে চাইবে। তাতে এ খাতের রাজস্ব কমবে, বাড়বে কালো টাকা।

আইন মন্ত্রণালয়ের ভূমি নিবন্ধন অধিদপ্তরের অধীনে জেলা, উপজেলা পর্যায়ের সাব-রেজিস্ট্রাররা সারাদেশে জমি রেজিস্ট্রেশনের কাজ করছেন। এ খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব জমা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তহবিলে। এ কারণে যে কোনোভাবেই হোক রেজিস্ট্রেশনের সময় জমির প্রকৃত মূল্যের প্রতিফলন চায় এই দুই মন্ত্রণালয়।

আইন মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জমির গুরুত্ব ও মূল্য বিবেচনা করে মৌজাকে ভাগ করা হলে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছের জমির বাজার মূল্য বেশি হবে। এসব জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন ফি বেশি হবে। ওইসব স্থাপনা থেকে দূরের নিম্ন শ্রেণির জমির মূল্য তুলনামূলক কম হবে। তাতে ওইসব স্থানের জমি কেনা-বেচায় রেজিস্ট্রেশন ফিও কম হবে।

জানা গেছে, বাণিজ্যিক, আবাসিকসহ উন্নত শ্রেণির জমির উচ্চ মূল্য ও একই মৌজার নাল, কৃষিসহ অন্যান্য নিম্ন শ্রেণির জমির কম মূল্য গড় করে বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। তাতে ওইসব গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান জমির মূল্যের প্রভাব পড়ে মৌজার কম মূল্যের জমির ওপর। অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন শ্রেণির জমি কেনা-বেচায় জমির মোট মূল্যের চেয়ে রেজিস্ট্রেশন ফি বেশি হয়ে যায়। এতে ওইসব ক্রেতা-বিক্রেতারা জমি রেজিস্ট্রেশনে আগ্রহী হন না।

আইন মন্ত্রণালয়ের ভূমি নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শক খান মো. আবদুল মান্নান সমকালকে বলেন, জমির বর্তমান বাজার মূল্যে বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য দূর করতে মৌজাকে গুচ্ছ গুচ্ছ করে ভাগ করে নতুন মূল্য হার নির্ধারণ করতে হবে। মহানগর, জেলা, উপজেলা শহর, পৌরসভা, অন্যান্য শহর, বাজার ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশের জমির মূল্য ও একই মৌজার তুলনামূলক অগুরুত্বপূর্ণ জমির মূল্য আলাদাভাবে নির্ধারণ করতে হবে। মূল্য বৈষম্য দূর করতে এটি জরুরি।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, মূলত ২০০২ সাল থেকে জমির বাজার মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০৪ সালে এটি বাধ্যতামূলক করা হয়। এরপর ২০১০ সালে মৌজাভিত্তিক বাজার মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।

২০০২ সালের আগে স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণ করে জমি রেজিস্ট্রেশন করা হতো। স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে ক্রেতা-বিক্রেতারা তাদের ইচ্ছে মতো মূল্য উল্লেখ করতেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারদের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ ছিল না। তাতে ওই সময় বর্তমানের চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় হতো এ খাত থেকে।

ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার ও বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দীপক কুমার সরকার সমকালকে বলেন, মৌজাভিত্তিক জমির মূল্যে অসামঞ্জস্যতা ক্রমেই বাড়ছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে জমির গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রতিটি মৌজাকে ভাগ করে জমির প্রকৃত বাজার মূল্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, মৌজাভিত্তিক মূল্য প্রথা প্রত্যাহার করে আবারও স্বনির্ধারণী পদ্ধতি চালু করা হলে এ খাতের রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।

ভূমি নিবন্ধন পরিদপ্তরের এক পদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ উন্নত শ্রেণির জমি ও নিম্ন শ্রেণির তুলনামূলক অগুরুত্বপূর্ণ জমির মৌজা মূল্য আলাদাভাবে নির্ধারণ করে রেজিস্ট্রেশন ফি আদায় করা হলে জমির দলিল করার ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। এ কারণে এই খাতের রাজস্ব আয় বেড়ে যাবে। তাতে একদিকে সরকার লাভবান হবে অন্যদিকে কম মূল্যের জমি ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসবে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাত থেকে ১১ হাজার ৭শ' কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আদায় হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা।

দেশের সব জেলা রেজিস্ট্রারের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি কর্তৃক মৌজাভিত্তিক জমির বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হলেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সরকার নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য হাউজিং কর্তৃপক্ষ নিজেরাই তাদের আবাসিক প্লটের দাম নির্ধারণ করেন। পর্যায়ক্রমে ওইসব প্লটের মূল্য পর্যালোচনা করে মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হয় না।

জমির বাজার মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি

দেশের সব জেলা রেজিস্ট্রারের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি কর্তৃক প্রতি দুই বছরের প্রথম বছরের জানুয়ারি-ডিসেম্বর ও পরবর্তী বছরের জানুয়ারি-অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিটি মৌজার জমির কবলা দলিলের মূল্য গড় করে ওই মৌজার জমির বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এই কমিটি জমির প্রতি শতাংশ হিসেবে বাজার মূল্য নির্ধারণ করে যা একটি মৌজার জমির ভিত্তি মূল্য। কেনা-বেচার সময় ভিত্তি মূল্যের নিচে জমি রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ নেই। আবার ভিত্তি মূল্যের ওপরে দাম নির্ধারণ করে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রেও কোনো বাধা নেই।

অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাজারদরে দলিল সংখ্যা কমছে

সারাদেশে জমির অসামঞ্জস্যপূর্ণ বৈষম্যমূলক মূল্যের কারণে জমির দলিলের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। উচ্চ মূল্যের ও কম মূল্যের জমির গড় মূল্য অনুযায়ী বাজার মূল্য নির্ধারণ করায় কম মূল্যের জমি ক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ বাড়তি অর্থ খরচ গুনতে হচ্ছে। এ কারণে 'নাল', 'ডোবা', 'কৃষি', সমতলসহ অন্যান্য নিম্ন শ্রেণির জমি ক্রেতারা দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এ কারণেই সারাদেশে জমির দলিলের সংখ্যা কমেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সারাদেশে মোট দলিল হয় ৩৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৪২টি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দলিল হয় ২৯ লাখ ৪৯ হাজার ৯৩৬টি। এই হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দলিলের সংখ্যা কমেছে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৬০৬টি।

জমির মূল্য থেকে কীভাবে কালো টাকা হয়

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উচ্চ মূল্যের জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা সলাপরামর্শ করে বাড়তি মূল্য গোপন করে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত দামে রেজিস্ট্রেশন করছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে লেনদেন হচ্ছে ওই বাড়তি টাকা। ওই বাড়তি টাকাই কালো টাকা। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের প্রধান সড়কের পাশের এক কাঠা জমি ৫ কোটি টাকায় বিক্রি হলেও সেটি রেজিস্ট্রেশনের সময় ক্রেতা-বিক্রেতার সমঝোতায় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত প্রতি কাঠার মূল্য পঞ্চাশ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বাকি সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যক্তি পর্যায়েই লেনদেন হয়। তাতে বিক্রেতার আয়কর রিটার্নে ওই সাড়ে ৪ কোটি টাকার হিসাব উল্লেখ করা হয় না, যা কালো টাকা হয়ে যায়। অন্যদিকে ক্রেতার ওই জমিতেও অপ্রদর্শিত হিসেবে থেকে যায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এটিও কালো টাকারই অংশ। কালো টাকা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

 

http://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/18035957