২৯ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৭

হাতিরঝিল এখন মশারঝিল

কচুরিপানা, ময়লা-আবর্জনা আর দখলের কবলে ঢাকার জলাশয় ৬

পরিষ্কার না করায় রাজধানীর নিচু জমিন, ঝিল ও লেকগুলো হয়ে উঠেছে আবর্জনার ভাগাড়। এ সমস্ত ময়লা আবর্জনায় জন্মাচ্ছে মশা। দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এসব প্রজনন স্থলে মশা নিধনে নেই কোনো উদ্যোগ। যে কারণে খাল, ঝিল, জলাশয় ও নালাগুলো এখন মশার আদর্শ প্রজননস্থলে পরিণত হয়ে গেছে। মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী।
রাজধানীর রামপুরা সেতুর ওপর দাঁড়ালে পশ্চিমে হাতিরঝিল। আর ঠিক তার উল্টো দিকে তাকালেই চোখে পড়ে পচা-গলা ময়লা আবর্জনায় ভরা দুর্গন্ধময় রামপুরা খাল। হাতিরঝিলের পানিও ময়লা আবর্জন মিশে দুগন্ধময় হয়ে গেছে। ঝিলের পানিতে ভাসছে ময়লা-আবর্জনা আর বিভিন্ন স্থানে জড়ো করে রাখা হয়েছে ময়লার স্তূপ। এ সমস্ত ময়লায় জন্ম নেয়া মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ দর্শনার্থী ও এলাকাবাসী। হাতিরঝিল এলাকার মহানগর আবাসিক প্রকল্পের বাসিন্দা সামছুদ্দিন আমহদ বলেন, হাতিরঝিল এখন আর হাতিরঝিল নেই এটা মশারঝিল হয়েগেছে।

রামপুরা ব্রিজ থেকে আফতাবনগার ও মেরাদিয়ার দিকে যাওয়া খালটিতে দুই সিটি কর্পোরেশনের ময়লা-আবর্জনা ফেলে একেবারে ময়লার ভাগাড়ে করে ফেলেছে। রামপুরা সেতু থেকে খালটি মেরাদিয়া বাজার হয়ে বালু নদের সঙ্গে মিশেছে। খালের এক পাশে বনশ্রী আবাসিক এলাকা, অন্য পাশে আফতাবনগর। সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্প। রামপুরা সেতু থেকে বনশ্রী সড়ক ধরে যতই এগোনো যায়, খালে ময়লার পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। আফতাবনগরের পাড়ের চেয়ে বনশ্রী পাড়ে আবর্জনা বেশি। পুরো পাড়ই ময়লার ভাগাড়। পানির রং কালো। চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খালের মধ্যে বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা ভাসছে। সরজমিনে গতকাল বুধবার সোনারগাও হোটেলের পিছনের হাতিরঝিলের অংশ থেকে হাতিরঝিল প্রজেক্ট, রামপুরা ব্র্রীজ হয়ে মেরাদিয়া পর্যন্ত ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। এই ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের নেই কোন উদ্যোগ। এ ময়লা আবর্জনায় জন্ম নেয়া মশার যন্ত্রণায় পুরা হাতিরঝিলের আশেপাশের এলাকার তেজগাও, গুলশান, রামপুরা, দিলু রোড়, মহানগর আবাসীক এলাকা, আফতাব নগার ও মেরাদিয়ার মানুষ অতিষ্ঠ। মশার যন্ত্রণায় দিনের বেলাতেও কোথাও স্বস্তিতে একটু স্থির হয়ে বসতে পারে না ওই সমস্ত এলাকার মানুষ। দিনে রাতে ২৪ ঘণ্টাই এখন মশার যন্ত্রণায় রয়েছে ওই এলাকাবাসী।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোহাম্মদ জাকির হাসান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, রাউজক, গণপুর্ত অধিদপ্তর, সিভিল এভিয়েশন, রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এ লেক, ঝিল ও জলাশয়গুলোর মালিক। এছাড়া ব্যক্তি মালিকানয়ও রয়েছে কিছু জলাশয়। এসব জলাশয় পরিষ্কারের জন্য কর্পোরেশনের আলাদা বাজেট নেই, তাছাড়া এগুলো পরিষ্কারের দায়িত্বও সিটি কর্পোরেশনের নয়। তিনি বলেন, এ পুকুর, জলাশয়গুলো পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এ কাজে রয়েছে নানা আইনি জটিলতাও। যে কারণে খুব সহজেই আমরা রাজধানীল জলাশয়গুলো থেকে ময়লা আবর্জনা ও কচুরিপানা পরিষ্কারের কাজে হাত দিতে পারি না।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, এটা এখন মশার খামারে পরিণত হয়ে আছে। এ খালটির মালিকানা নামকাওয়াস্তে ঢাকা ওয়াসার থাকলেও বর্তমানে অনেকটাই অভিভাবকত্বহীন এই খালটি দীর্ঘদিন অযতœ আর অবহেলায় রয়েছে। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ খালটিতে কখনও মশার ওষুধ ছিটানো হয়েছে বলে কেউ বলতে পারেনি। গত ১০ বছর যাবত এটি পরিষ্কারও করা হয় না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এই খালটিকে ‘মশার খামার’ বলে মন্তব্য করে রামপুরার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, মাঝে মধ্যে এখানে সিটি কর্পোরেশনের লোকজন এসে ধোয়া দিয়ে যেতে দেখি কিন্তু তাতে কি হবে। তারা ধোয়া দেয় আবার আমাদেরকে দিনে রাতে ২৪ ঘণ্টা মশাও কমড়ায়। এ ধোয়া দেয়ার কি দরকার।

গতকাল হাতিরঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দৃষ্টিদন্দন হাতিরঝিলের পরিবেশ এখন বিপর্যয়ের মুখে। ঝিলের পানিতে ভাসছে ময়লা পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা। দশনার্থী ও পথচারীরা নাকে রুমাল চেপে ঝিলের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। শহরের কোলাহলের মাঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে গড়ে ওঠা ঢাকাবাসীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হাতিরঝিলের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে রক্ষণা বেক্ষণের অভাবে। গুলশান লেক, কারওয়ান বাজার ও বেগুনবাড়ী দিয়ে হাতিরঝিলের পানিতে প্রতিনিয়ত ময়লা-আবর্জনা ঢুকছে। দর্শনার্থী ও পথচারীরাও ঝিলের পানিতে ময়লা আবর্জনা ফেলে পানিকে দূষিত করছেন। দর্শনার্থীদের ফেলা কাগজের টুকরা, পলিথিন, খাবারের বক্সসহ অন্যান্য ময়লা-আবর্জনার কারণে দূষিত হচ্ছে ঝিলের পানি। অনেক দর্শনার্থী ঝিলের রাস্তার ও ব্রিজের পাশে মলত্যাগও করছেন, যা পুরো এলাকার পরিবেশকে দূষিত করছে। ঝিলের রাস্তার পাশে ডিএসসিসি’র স্থাপিত মিনি ডাস্টবিনগুলোও উদাও হয়ে গেছে। কোন একসময় এখানে সিটি কর্পোশেন কিছু মিনি ডাস্টবিন স্থাপন করেছিল তার অস্তিত্ব কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

চারদিকে শুধু ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। পানির ময়লা পরিষ্কারের জন্য আধুনিক যন্ত্র বসানো হলেও তা শতভাগ চালু নেই। বরং এর পাশেই আগে উঠানো আবর্জনা জড়ো করে রাখা হয়েছে। ঝিলের কিনারা ঘেঁষেও অনেক স্থানে আবর্জনার স্তূপ দেখা গেছে। ঝিলের পানি বহমানও নয়। ফলে পানিতে ভেসে থাকা ময়লা-আবর্জনা পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশে। কোন কোন এলাকার পানি কালো রং ধারণ করেছে। আবার কোন কোন এলাকার পানি ধূসর ও সবুজ রং ধারণ করেছে। ফলে হাতিরঝিল সংলগ্ন এলাকার পরিবেশও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঝিলের আশপাশের এলাকার পানি ড্রেন দিয়ে ঝিলের পানিতে পড়ে। পানির সাথে ময়লা-আবর্জনাও চলে আসে। সেসব ময়লা পচে এখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ###

https://www.dailyinqilab.com/article/123705