দূষণে বুড়িগঙ্গার পানি কালো হয়ে গেছে। ছবিটি রাজধানীর সোয়ারীঘাট এলাকা থেকে তোলা
২২ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৮

প্রাণ হারাচ্ছে নদী

আজ বিশ্ব পানি দিবস

ঢাকার চার নদী সর্বাধিক দূষিত ; মাছ, জলজ উদ্ভিদ মরে সাফ ; আক্রান্ত নদীপাড়ের মানুষ প্রাণিকুল


সকালে বাদামতলীর ঘাটে ছোটখাটো একটা জটলা চলছিল। উৎসুক মানুষ ভিড় জমিয়েছে একটি মৃত্যু পথযাত্রী কুকুরকে ঘিরে। রাস্তাঘাটে প্রায়ই কুকুর বেড়াল মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু কেউ উৎসাহ নিয়ে দেখতে তো যায়ই না, বরং নাকে রুমাল চেপে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু এখানে একটি কুকুরকে নিয়ে উৎসাহের কারণ জানা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই এর মৃত্যুর পর।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে কুকুরটির মৃত্যু ছিল অস্বাভাবিক। সেটির গা ছিল ভেজা। গা থেকে কালো আলকাতরার মতো পানি চুঁইয়ে মাটিতে পড়ছিল। মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। জিভ পুরোটাই বেরিয়ে গেছে। কুকুরটি নাকি কিছুক্ষণ আগেই জিঞ্জিরা প্রান্ত থেকে সাঁতরে বুড়িগঙ্গা পার হয়েছে। এপারে এসেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে শুয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কুকুরটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মানুষের অতি আগ্রহের বিষয়টি ছিলÑ বুড়িগঙ্গার পানি যে কতটা দূষিত (বিষাক্ত) হয়ে গেছে, যাতে একটি কুকুরও মারা গেল তা দেখার জন্য।

সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীতে মাছ দূরে থাক এখন আর কোনো জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। যে টলটলে পানিতে একসময় আয়নার মতো নিজের চেহারা দেখা যেত সেখানে এখন আলকাতরা সদৃশ পানি। পানির ঘনত্বও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বুড়িগঙ্গার তীরে বসবাসকারী ও এ নদীর দুর্গন্ধযুক্ত পচা পানি ব্যবহারকারী ৮০ শতাংশ মানুষই চর্মসহ বিভিন্ন পানিজনিত রোগে ভুগছেন। নদীগুলোর পানি ব্যবহারকারী প্রাণিকুলও বিপদগ্রস্ত। শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, ঢাকাকে ঘিরে রাখা প্রধান চার নদীর মধ্যে তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যাও ভয়াবহ দূষণের কবলে পতিত। বিশাল এ ঢাকা শহরের সব পয়ঃ ও শিল্প বর্জ্য নিক্ষেপের স্থান হচ্ছে এ নদীগুলো। দূষণের পাশাপাশি দখলও এসব নদী ধ্বংসের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কাজেই এক সময় ঢাকার ঐতিহ্য এসব নদীকে এখন আর নদ বা নদী না বলে বর্জ্য নির্গমনস্থল বললে অত্যুক্তি হবে না। এসব নদীর পানি এতটাই বিষাক্ত হয়ে গেছে যে, নদীর পানি প্রাণী অর্থাৎ জলজ উদ্ভিদ, মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে নদীর পানি দিন দিন নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আবদুর রব মোল্লা তার গবেষণা প্রতিবেদন জানান, শুধু বুড়িগঙ্গা নয় ঢাকার চার পাশে সব নদীতে এখন কোনো ধরনের জলজ প্রাণীর পক্ষ বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। ঢাকা মহানগরীর অভ্যন্তরীণ জলাশয় ও পার্শ্ববর্তী নদীগুলো দূষণের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি জানান, ঢাকা মহানগরীর ঘিরে রাখা নদীনালা-খাল-বিল ও জলাভূমির দূষণমাত্রা আর সহনীয় পর্যায় নেই। রাজধানী ঢাকা জলাশয় হারানোর সাথে পাল্লা দিয়ে পানির গুণাগুণের ক্রমাবনতি ঘটছে অস্বাভাবিকভাবে।
দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রায় শূন্যের কোঠায়
ড. মো: আবদুর রব মোল্লা তার গবেষণায় তুলে ধরেছেন, যে ঢাকার আশপাশ নদীর পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কোথাও কোথাও কমে আসে প্রায় শূন্যের কোঠায়। এ মাত্রায় প্রায় সব জীবেরই জীবনধারণ সম্ভব হয় না। অ্যামোনিয়া ও নাইট্রাইটের মত দূষিত পদার্থের পরিমাণ ওঠা-নামা করে যাথাক্রমে ০ দশমিক ৭৯ থেকে ৩০ দশমিক ৫২ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার এবং ০ দশমিক ১০ থেকে ৮ দশমিক ১৬ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারের মধ্যে। রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা (কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড) এবং জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা (বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড) ওঠানামা করে যাথাক্রমে ১৮ দশমিক ০ থেকে ৪৮০ দশমিক ০ মিলিগ্রাম/ লিটার এবং ৫ দশমিক ০ থেকে ৮০ দশমিক ০ মিলিগ্রাম/ লিটার পর্যন্ত। এসবের অতিমাত্রা নির্দেশ করে রাসায়নিক ও জৈবিক পদার্থের উপস্থিতি। এর উচ্চমাত্রা পানি দূষণের নির্দেশক। তিনি জানান, ঢাকার নদী বা খালের পানির ইলেকট্রিক্যাল পরিবাহিত (২১২ থেকে ৪২০০ মাইক্রসিমেন) এবং দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের (১১৮ থেকে ৩১৫০ মিলিগ্রাম/লিটার) উপস্থিতিও অনেক বেশি, যা নির্দেশ করে পানিদূষণের উচ্চমাত্রা। বিষাক্ত ভারি ধাতুর উপস্থিতিও বহুগুণে বেশি। যা জলজ জীবসহ মানুষের জন্য অত্যন্ত তিকর। পানিতে এ ধরনের বিষাক্ত দ্রব্যের এ উচ্চ মাত্রায় জীবন ধারণ কঠিন। শুকনো মওসুমে নদী ও খালের দূষিত অংশে মাছশূন্য থাকে।

দূষণের দায় কার?
প্রতিদিনই বুড়িগঙ্গা দূষণের শিকার হচ্ছে। প্রতিদিনই নানান ধরনের বর্জ্য রাজধানী পাশের এ নদীতে ফেলা হচ্ছে। ড. মো: আবদুর রব মোল্লা জানান, প্রতিদিন গড়ে ৬০ হাজার ঘনমিটার দূষিত বর্জ্য এসব জলাশয়ে ফেলা হয়। গড়ে প্রতিদিন ৭ হাজার টন কঠিন বর্জ্য অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে নিপে করা হয়। পোশাকশিল্প থেকে বছরে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন টন দূষিত বর্জ্য এসব জলাশয় যোগ হচ্ছে। তা ছাড়া একসময় প্রতি বছর গড়ে ৮৮ মিলিয়ন কঠিন বর্জ্য এবং ৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন তরল বর্জ্য চামড়া শিল্প থেকে নদীতে নিপে করা হতো, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া এখনো যায়নি। এ ছাড়া গৃহস্থালির ময়লাপানি সবটাই গড়ায় এসব জলাশয়ে। এ ভয়াবহ চিত্র দেশের অন্যান্য অঞ্চলের নদীগুলোরও। অধিকাংশ নদীই নাব্যতা হারিয়েছে। অনেক নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
এহেন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই প্রতি বছরের মতো আজ বৃহস্পতিবার পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পানির জন্য প্রকৃতি’ (ঘধঃঁৎব ভড়ৎ ডধঃবৎ)।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/303861