২২ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৭

গভীর সংকটের মুখে বিআইএফসি

নিজের প্রতিষ্ঠানেই ৫১৮ কোটি টাকা খেলাপি

গ্রাহকের দায়দেনা শোধ করা যাচ্ছে না

গভীর সংকটে পড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লি. (বিআইএফসি)’। সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ও পরিচালকরা নামে-বেনামে ৫১৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির এ অবস্থা। বর্তমানে ওই ঋণ সুদসহ ৯২৯ কোটি টাকা হয়েছে। নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে আবদুল মান্নান বিপুল অঙ্কের এ অর্থ বের করে নেয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের তারল্য সংকটের মুখে পড়েছে। ফলে গ্রাহকদের দায়দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (এফআইডি) প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির ওপর বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সিনিয়র সচিব ইউনুসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিআইএফসির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করতে পারবে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্ষমতা দেয়া আছে। পাশাপাশি ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার ও গ্রাহকদের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। কারণ বিআইএফসির ঋণ অনিয়মের ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংক শেষ প্রান্তে এসে উদ্ঘাটন করেছে। শুরুতে চিহ্নিত করা গেলে ব্যবস্থা নিয়ে অনেকটা রক্ষা করা যেত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির মোট বকেয়া ঋণ প্রায় ৮৫৭ কোটি টাকা। এর ৯৩ শতাংশ অর্থাৎ ৭৯৭ কোটি টাকা খেলাপি। এর মধ্যে ৫১৮ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিআইএফসিতে বিভিন্ন মেয়াদে চেয়ারম্যান হিসেবে আবদুল মান্নান দায়িত্বে ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ পরিচালক পদে ছিলেন তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান। এ ছাড়া তার দুই মেয়েসহ আরও কয়েকজন নিকটাত্মীয় ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পরিচালক ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিআইএফসি থেকে নামে-বেনামে আবদুল মান্নান এবং তার পরিবারের সদস্য পরিচালক ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ঋণের আড়ালে ৫১৮ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। যা সুদ-আসলে বর্তমানে ৯২৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ অনিয়মের দায়ভার ওই সময় স্বীকার করে চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী নিয়মবহির্ভূতভাবে উত্তোলিত অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি ব্যাংলাদেশ ব্যাংককে দেন। ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ কিস্তিতে প্রায় ১২০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। বাকি অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটি (বিআইএফসি) থেকে বারবার তাগাদা দেয়ার পরও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে অর্থ পরিশোধের অঙ্গীকার করলেও প্রতিশ্র“তির অর্থ ফেরত না দিয়ে নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করছেন সাবেক চেয়ারম্যান।

জানা গেছে, এ প্রতিষ্ঠানের ৫০ শতাংশ শেয়ারের মালিক বিদেশি তিনটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে- ফাইভ কনটিনেন্টস ক্রেডিট লি., টিস মার্ট ইন্টারন্যাশনাল লি. ও মেরিল অ্যান্ড ফরবেস ইন্টারন্যাশনাল লি.। তিন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় আছে। এদের তথ্য চেয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক পায়নি। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পাইওনিয়ার ড্রেসেস ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ, সুকুজা ভেঞ্চার ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ, সাধারণ বিনিয়োগকারীর ১৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মালিকানা শেয়ার ২১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঋণের নামে এ প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে বিধিবহির্ভূতভাবে টাকা উত্তোলন করায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ২৬(১) ধারায় তিন পরিচালককে অপসারণ করা হয়। এ ছাড়া পাইওনিয়ার ড্রেসেসের প্রতিনিধি উম্মে কুলসুম মান্নান, তানজিলা মান্নান ও খালেদ আমিরুল করিম ঋণখেলাপির দায়ে প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ থেকে অপসারিত হয়েছেন। এ ছাড়া আব্বাস উদ্দিন আহমেদ এবং আরশাদ উল্লাহ পদত্যাগ করেন। তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে বিআইএফসিকে চিঠিও দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান মেসার্স হুসাইন ফরহাদ অ্যান্ড কোং-এর নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত আবদুল মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিএফআইসি বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। যার বকেয়া স্থিতি ৬২১ কোটি টাকা। দণ্ডসুদসহ বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৯২৯ কোটি টাকা। এসব খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে গভীর তারল্য সংকটে ভুগছে। পাশাপাশি গ্রাহকদের দায়দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কো. (বিআইএফসি) ১৯৯৬ সালের ১০ আগস্ট যাত্রা শুরু করে। কোম্পানি আইন-১৯৯৪-এর আওতায় এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা হয়। এর অনুমোদিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১০০ কোটি টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানি।

 

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/30154