২২ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৫

কোটাধারীদের বিলাসিতা, বঞ্চিতদের হাহাকার

সাধারণ ঘরের সন্তান কাউসার আহমেদ। ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হন। ২০১২ সালে একাডেমিক পাঠ শেষ করে নেমে পড়েন চাকরিযুদ্ধে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর— উভয়টাতেই প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন। সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যেই লাইব্রেরিতে আসা আর রাত ৮টায় ফিরে যাওয়াই তাঁর নিয়মিত রুটিন। এভাবেই চলছে ছয় বছর। তিনটি বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আওতায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি মিলে চাকরির ১৪টি মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিনি। তবে কোথাও চাকরির সুযোগ পাননি। চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
লোক প্রশাসন বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৮টায় লাইব্রেরিতে আসেন, ফেরেন রাত ৮টায় গ্রন্থাগার বন্ধ হলে। নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এখন পর্যন্ত আটটি চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এখনো তাঁর জীবনের গতি ঠিক হয়নি।

এমন উদাহরণ শত শত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও শাহবাগের গণগ্রন্থাগারের সামনে দাঁড়িয়ে জানার চেষ্টা করলেই মিলবে এমন উদাহরণ। সারা দেশেই চাকরিপ্রত্যাশীদের এমন চিত্র বলে জানা যায়। শত শত তরুণ বছরের পর বছর চেষ্টা করে চাকরি জোটাতে পারছে না।
তাদের অভিযোগ, সংরক্ষিত কোটাব্যবস্থার কারণেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রসঙ্গত, দেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোটা ৫৫ শতাংশ। এই ৫৫ শতাংশের মধ্যে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। এই হিসাবের জন্য আন্দোলনকারীরা বলছে, বাস্তবে সংরক্ষিত কোটা হচ্ছে ৫৬ শতাংশ। আর কোটাধারীরা সংখ্যায় কম হওয়ায় ‘ভালো’ সরকারি চাকরি পাচ্ছে। বিদ্যমান কোটাকে বৈষম্য আখ্যা দিয়ে বিক্ষুব্ধ চাকরিপ্রত্যাশীরা এই ব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলনে নেমেছে। বিদ্যমান ৫৫ শতাংশ কোটা ১০ শতাংশে নামানোসহ পাঁচ দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একত্র হয়ে তারা কর্মসূচি পালন করছে। এরই মধ্যে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ২৫ মার্চ রবিবার গলায় সনদ ঝুলিয়ে শাহবাগ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত রাস্তা ঝাড়ু কর্মসূচি এবং ২৯ মার্চ নাগরিক ও উন্মুক্ত সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে।

তাদের পাঁচ দাবি হচ্ছে, ৫৬ শতাংশ থেকে কোটা ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদে মেধায় নিয়োগ দেওয়া, নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করা, কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা কোটায় ব্যবস্থায় না নেওয়া ও চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিন্ন কাটমার্ক (প্রাথমিক বাছাইয়ে নির্ধারিত নম্বর) এবং অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা। সরকার এরই মধ্যে কোটায় শূন্যপদ মেধা থেকে পূরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্তের পরও অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে কোটার পদ শূন্য রাখা হয়েছে।
আন্দোলনকারীরা বলছে, বেশির ভাগের ক্ষেত্রে কম কোটা আর কম ভাগের জন্য বেশি কোটা সংরক্ষণ করায় বঞ্চিত হচ্ছে লাখ লাখ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাই কোটাও সংস্কার করা সময়ের দাবি।
তাদের অভিযোগ, পদ সংরক্ষণের কারণে কোটাধারীরা সহজেই চাকরি তো পাচ্ছেই, পছন্দমতো চাকরি পেতে একের পর এক চাকরিও বদল করছে তারা। একটি চাকরিতে যোগ দিয়ে পরবর্তী সময়ে ‘ভালো’ চাকরির সুযোগ পেলে বদলে ফেলছে। এতে ওই পদ ফাঁকা রয়েই যাচ্ছে। এতে দেশে বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে।

সূত্র জানায়, দেশের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান ৫৫ শতাংশ কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, সব জেলার জন্য ১০ শতাংশ আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করেছেন আফসার আলী। ২০১০ থেকে আট বছর লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করে তিনি ৩৩তম, ৩৪তম, ৩৬তম ও ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। বিসিএস বাদেও সব মিলিয়ে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির এক ডজনের বেশি চাকরির পরীক্ষায় মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু চাকরি ধরা দেয়নি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোটার কারণে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় বারবারই বাদ পড়তে হয়েছে। ১০০ পদের মধ্যে ৫৬ জনই কোটায় নেওয়া হয়। মেধার ভিত্তিতে ৪৪ জন নেওয়া হয় সাধারণ বিভাগ থেকে।

সূত্র জানায়, কোটাধারীরা এক চাকরিতে যোগ দিয়ে অন্য ভালো চাকরি পেয়ে গেলে আগেরটি ছেড়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করার এক বছরের মাথায় এ রকম একজন সাবরেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কিছুদিন পরেই সাবরেজিস্ট্রার পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক (এডি) পদে যোগদান করেন। সম্প্রতি ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় এএসপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন; তবে এখনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি।
কৃষি ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা হয়েছিলেন সেলিম আক্তার। রূপালী ব্যাংকেও সিনিয়র অফিসার হয়েছিলেন তিনি। ৩৩তম বিসিএসে ক্যাডার হিসেবে যোগদানও করেছিলেন। কিন্তু সর্বশেষ ৩৬তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে নির্বাচিত হওয়ায় এতে যোগদানের অপেক্ষায় আছেন। আর তাঁর আগের পদগুলো ফাঁকা রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বছরের পর বছর পড়ালেখা করেও কোনো চাকরির সুযোগ পাচ্ছি না। পরিবারের সদস্যরা আমাদের মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। আমাদের এই দুঃখ কেউ দেখে না।’
কমসংখ্যকদের বেশি কোটা সংরক্ষণকে বৈষম্য আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, যাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তারা সংখ্যায় খুবই কম। ৫৬ শতাংশ কোটাধারী চাকরিপ্রত্যাশী কম হওয়ায় তারা সহজেই সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাচ্ছে। আর সাধারণরা রাত-দিন খেটেও চাকুরি পাচ্ছে না। কোটাধারীরা একের পর এক চাকরিও পরিবর্তন করছে। একটি চাকরিতে যোগদান করে ‘ভালো’ চাকরির সুযোগ পেলে আগেরটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/03/22/616230