২২ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৬

কোটার গ্যাড়াকলে ‘মেধা’ দায় কার?

বুয়েট থেকে পাস করে আমার এক আত্মীয় আমেরিকার ক্যালিফোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। ওই তরুণ কিভাবে ফুয়েল (তেল-গ্যাস) ছাড়াই বাস-ট্রাক চলানো যায় তা নিয়ে গবেষণা করছেন। বিগত ’৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় বাংলাদেশের একজন সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রীর ছেলের চাকরি হয় আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস এন্ড স্পেস এডিনিষ্ট্রেশনে (নাসা)। সেখানে যোগদান না করে বেশি বেতনে একটি উড়োজাহাজ নির্মাণ কোম্পানীতে চাকরি নেন। দেশের এই দুই মেধাবীর জ্ঞান বিদেশীরা কাজে লাগাচ্ছেন। অথচ তাদের সেবার প্রতি এদেশের মানুষের হক আছে। দেশের মানুষ তাদের সেবা থেকে বঞ্ছিত। শুধু কী ওই দুই তরুণ। প্রতি বছর বুয়েট, নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা হাজার হাজার মেধাবী ছেলেমেয়ে ভাগ্য গড়তে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি দিচ্ছেন। তাদের অনেকেই বিদেশে ভূঁইয়ে সাফল্য দেখিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের ছেলেদের জ্ঞান-মেধা কাজে লাগিয়ে বিদেশে সাফল্যের শিখরে উঠছেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করে আমরা ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলছি; অথচ আমাদের ভুলের জন্য তাদের সেবা নিচ্ছে বিদেশীরা! দেশের নীতি নির্ধারকরা কী ভেবে দেখছেন কেন আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েরা বিদেশ যাচ্ছেন? কেন তাদের সেবা থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে? কারণ আর কিছু নয়; চাকরির অভাব। চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কারণে আমরা মেধাবীদের দেশের কাজে লাগাতে পারছি না। দেশের জন্য আবশ্যক দক্ষ জনশক্তি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করছি; তাদের কাজে লাগাতে পারছি না। অথচ মেধাবী কর্মকর্তার অভাবে রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি টিভির টকশোয় সরকারের সাবেক দ’ুজন ঝানু আমলা দুঃখ করে বলেছেন, প্রশাসনে উচ্চপদে কাজ করেন এমন অনেকেই ঠিক মতো নোট লিখতেও জানেন না।

সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৯ অনুচ্ছেদের (১)-এ বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। (৩) জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ প্রশ্ন হলো সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সুচিন্তিতভাবে সংবিধানের এই ধারাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে কেন? সরকারি চাকরি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ বিভিন্ন স্তরে কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করায় যোগ্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন আর অযোগ্যরা কোটার সুযোগে সুবিধা নিয়ে বিড়ম্বনায় ফেলছেন।

বর্তমানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর ৫ শতাংশ, আর প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাকি ৪৪ শতাংশ মেধাবীদের জন্য বরাদ্দ। এই মেধা কোটায় নিয়োগে দুর্নীতি এবং টাকা পয়সার লেনদেন হচ্ছে তাতে প্রকৃত মেধাবীরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্ছিত হয়ে ভাগ্য গড়তে বিদেশ পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। মূলত স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ মেধা, ৪০ শতাংশ জেলা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা আর ১০ শতাংশ যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা ছিল। একটা প্রেক্ষাপটে ওই সময় কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। এখন সেই কোটা পদ্ধতির কতটুকু প্রয়োজন রয়েছে? অপ্রিয় হলেও সত্য যে চাকরি, ভর্তি ইত্যাদির কোটা পদ্ধতি করায় সচিব থেকে শুরু করে সাধারন মানুষের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সংগ্রহের হিড়িক পড়ে গেছে।

কোটা পদ্ধতিকে ‘উদ্ভট সিস্টেম’ অবিহিত করে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, বাংলাদেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ২৫৭টি কোটা রয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন উদ্ভট সিস্টেম নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে কোটা চালু হয়েছে দরিদ্রদের উপরে তুলে নিয়ে আসার জন্য; কাউকে পুরস্কৃত করার জন্য নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা সিস্টেম চালু হয়েছিল কারণ তাদের অবস্থা তখন খারাপ ছিল। কিন্তু এখন মুক্তিযোদ্ধার নামে যে কোটা দেওয়া হয় তা নিতান্তই অমূলক।’ প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এম আনিসুজ্জামানসহ অনেকেই কোটা পদ্ধতি সংশোধনের পক্ষ্যে অভিমত দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য কোটা পদ্ধতি পুরোপুরি বাদ না দিয়েও কমপক্ষে ৭০ ভাগ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে নেয়া উচিত।
কিছুদিন থেকে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন। স্বাধীন দেশে যোগ্য নাগরিকের কর্মসংস্থান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র কী সে দায়িত্ব পালন করতে পারছে? তাদের দাবি বিসিএসসহ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সেখানে মেধাবীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। অন্তত ৭০ শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে দেয়া হোক। কিন্ত কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করায় মেধাবীরা একদিকে চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন; অন্যদিকে প্রশাসনে দেখা দিয়েছে দক্ষ জনবলের অভাব। কোটা পদ্ধতির কারণে লেখাপড়া শেষ করে কাঙ্খিত চাকরি না পাওয়ায় মেধাবীরা বাধ্য হয়েই বিদেশ যাচ্ছেন। এতে দেশ মেধাবীদের সেবা থেকে হচ্ছে বঞ্ছিত। ফেব্রুয়ারী মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফডব্লি) এক জরীপে দেখা গেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যায়নরত ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগেরই জীবনের লক্ষ্য লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে গিয়ে চাকরি করবেন; কেউ বা পড়তে গিয়ে বিদেশেই থেকে যাবেন।

বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি জনশক্তি বিদেশে কাজ করছে। তাদের বড় একটা অংশের উপার্জিত অর্থ দেশে না এলেও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাদের রেমিটেন্সে দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার ভরে গেছে। মূলত আমাদের দেশের অদক্ষ শ্রমিকরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। আর দেশের মেধাবীরা বিদেশ চলে যাওয়ায় ব্যবসা-শিল্প ও সেবা খাতের চাহিদা মেটাতে বিপুলসংখ্যক দক্ষ কর্মী বিদেশ থেকে আনতে হচ্ছে। তারা আবার বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। প্রবাসী আমাদের এক হাজার শ্রমিক বিদেশ থেকে যে অর্থ পাঠায়; বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী একজন দক্ষ শ্রমিক সে পরিমান অর্থ নিয়ে যায়।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডবিøউইএফ) তরুণদের নিয়ে এক জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, পছন্দ মতো চাকরি, ভালো জীবনযাপন ও পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। এ ক্ষেত্রে তাঁদের পছন্দের দেশগুলো যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া। এসব তরুণ মনে করেন না যে নিজের দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ আছে। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লেয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শিরোনামে যে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় বাংলাদেশে যার শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। প্রতিবেদনটি যে সমস্ত তরুণ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চান, তাঁদের জন্য এক হতাশাজনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। শতকরা ৫৬ শতাংশ কোটা পদ্ধতির কারণে চাকরি না পাওয়াসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত তরুণ প্রজন্ম হতাশা থেকে বাঁচতে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

দেশের মেধাবী তরুণসমাজকে বিদেশমুখী হওয়ার প্রচণতা থেকে বাঁচাতে হবে। নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। মেধাবীদের চাহিদা মাথায় রেখে একদিকে যেমন নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা আবশ্যক; তেমনি তাদের দেশে ধরে রাখার জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। না হলে এক হতাশাজনক সময় অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট সন্তান। তাদের সন্তানদের জন্য অবশ্যই কোটা পদ্ধতি থাকবে। কিন্তু সেটা কতটুকু রাখা বাঞ্ছনীয় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে করা উচিত। তা না হলে কোটার গ্যাড়াকলে আটকে যাওয়া দেশের মেধাবীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে না। দেশের মেধাবীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমানো না গেলে মেধা পাচারের দায় রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা এড়াতে পারবেন না।

https://www.dailyinqilab.com/article/122607