২২ মার্চ ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:০৫

ঢামেক হাসপাতালে কোটি টাকার ট্রলি বাণিজ্য

নিয়ন্ত্রণে ৬ সরদার * রোগীর পকেট কাটে ৭৭ বহিরাগত * হাত রয়েছে ওয়ার্ড মাস্টারেরও

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলছে ট্রলি বাণিজ্য। এ হাসপাতালের
জরুরি বিভাগের ৬ সরদারের (চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী) নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় একটি সিন্ডিকেট নির্দ্বিধায় এ বাণিজ্য করে চলছে। এ সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করছে অন্তত ৭৭ বহিরাগত। তারা স্পেশাল বয় নামে পরিচিত। এরা ট্রলি দিয়ে রোগী বহন করার নামে স্বজনদের পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মাসে
অন্তত এক কোটি টাকা। এ টাকার একটা বড় অংশ যায় সরদারদের পকেটে। শুধু সরদাররা (চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী) নয়, জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার আবুলও এর ভাগ পান বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাংলাবাজার এলাকার ওয়াহিদ মোল্লা (৪৫) হৃদরোগে আক্রান্ত হলে স্বজনরা ২০ মার্চ রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালের ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে ওয়ার্ডে নেয়া হয়। তার নিকটাত্মীয় নাজমা বেগম যুগান্তরকে বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর পর একটি ট্রলিতে (ট্রেচার) করে ওয়াহিদ মোল্লাকে ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডে নেন দু’জন স্পেশাল বয়। বিনিময়ে তারা ৫শ’ টাকা দাবি করেন। পরে অনেক চেষ্টা করে তাদেরকে ৩শ’ টাকা দেয়া হয়। এমনিভাবে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা রোগী আন্নার (২০) স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় ৪০০ টাকা। প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে ২৭ জানুয়ারি আহত হন কামরাঙ্গীরচরের যুবক জাকির হোসেন। তার বাবা আবদুর রব জানান, জরুরি বিভাগের সামনে থেকে তার ছেলেকে ইমার্জেন্সি ওটিতে নিতে স্পেশাল বয়রা হাতিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ৪শ’ টাকা। শুধু ওয়াহিদ মোল্লা, আন্না ও জাকির হোসেনই নন- এরকম অন্তত ১২শ’ রোগীর কাছ থেকে এভাবে টাকা হাতিয়ে নেয় ট্রলি সিন্ডিকেট।

জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে অন্তত ১২শ’ রোগীকেই ট্রলিতে করে নিতে হয়। ট্রলিতে বহন করার নামে স্পেশাল বয়রা রোগীদের কাছ থেকে ৩শ’ থেকে শুরু করে ৮শ’ টাকাও আদায় করেন। গড়ে ৩শ টাকা করে ধরা হলেও স্পেশাল বয়রা প্রতিদিন রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তা মাস শেষে দাঁড়ায় ১ কোটি ৮ লাখ টাকায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ টাকার একটা বড় অংশ চলে যায় চতুর্থ শ্রেণীর ৬ কর্মচারীর পকেটে। এরা হাসপাতালের খুবই প্রভাবশালী। এদেরকে সরদার নামেই চেনেন সবাই। ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ট্রলি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ করছেন সরদার দেলোয়ার (বিক্রমপুর), সরদার ফুল মিয়া, সরদার আইয়ূব আলী, সরদার মোহাম্মদ আলম ওরফে ভাগিনা আলম, সরদার দেলোয়ার (মানিকগঞ্জ) ও সরদার আজিজ। তাদের নেতৃত্বে জরুরি বিভাগে তিন শিফটে চলে ট্রলি বাণিজ্য। একেক শিফটে দু’জন করে সরদার দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে দেলোয়ার ও ফুল মিয়ার অধীনে রয়েছে ৩০ জন বহিরাগত। আইয়ূব আলী ও আলমের নেতৃত্বে রয়েছে ২৫ জন বহিরাগত, এছাড়া মানিকগঞ্জের দেলোয়ার ও আবদুল আজিজের নেতৃত্বে রয়েছে ২২ জন বহিরাগত। কিন্তু কাগজে-কলমে এদের কোনো পরিচয় লিপিবদ্ধ নেই। এই সরদাররা বহিরাগতদের ওপর চালান অনিয়মের স্টিম রুলার। আর বহিরাগতরা এর শোধ নেন রোগীদের জিম্মি করে। তারা রোগীদের কাছ থেকে ট্রলি সেবা দেয়ার নামে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা।

সরদাররা সবাই ঢামেক হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেলোয়ার (বিক্রমপুর) ও আলম ওরফে ভাগিনা আলম। তাদের মধ্যে ভাগিনা আলম আওয়ামী লীগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইউনিটের সভাপতি। তাছাড়া চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সমিতির গত নির্বাচনে এ ৬ জনের ৪ জন বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, সরদার দেলোয়ারের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে ঢামেক হাসপাতালে। আর এ কারণে দেলোয়ারের প্রভাবও বেশি। দেলোয়ারের অধীনে সক্রিয় রয়েছে ৩০ জনের বেশি বহিরাগত। এদের কাছ থেকে দেলোয়ার প্রতিদিন ১০০ টাকা করে আদায় করেন। এছাড়া আয় অনুযায়ী যাওয়ার সময় তাকে একটা অংশ দিয়ে যেতে হয়। তাছাড়া স্পেশাল বয়দের কেউ কাজে না এলে দেলোয়ারকে দিনে একশ’ টাকা করে দিতে হয়। ছুটিও নিতে হয় দেলোয়ারকে টাকা দিয়েই। শুধু দেলোয়ারই নন, ট্রলি দেয়ার নামে স্পেশাল বয়দের কাছ থেকে প্রতিবার এ ১০০ টাকা করে আদায় করেন অন্য সরদাররাও।

জানা যায়, শুধু ট্রলির জন্য স্পেশাল বয়দের কাছ থেকে সরদার দেলোয়ার মাসে হাতিয়ে নেন প্রায় ১ লাখ টাকা। আর ফিটিং-সিটিং সব মিলিয়ে সরদার দেলোয়ারের মাসিক আয় মোটা অঙ্কের টাকা। এছাড়া সরদারদের কারও কারও বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। আরেক প্রভাবশালী সরদার হলেন আলম ওরফে ভাগিনা আলম। তিনি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সমিতির সাবেক সভাপতি আবদুল খালেকের ভাগিনা। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইউনিটের সভাপতিও তিনি। এ কারণে তার জন্য সব অনিয়ম হালাল। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হলেও তাদের চলন-বলন দেখলে যে কেউ মনে করবেন তারা কোনো বড় অফিসার। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। সরদার দেলোয়ার ঢামেক হাসপাতালে একটি কাচঘেরা রুমে বসেন।

রোগীরে জিম্মি না করলে কারে জিম্মি করব? : একজন স্পেশাল বয় অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই যুগান্তরকে বলেন, রোগীরে জিম্মি করে টাকা না নিলে কারে জিম্মি করে নেব? আমরা কি ডাক্তারকে জিম্মি করে টাকা নেব? আপনিই বলেন, আমাদের দিয়ে এ হাসপাতালে কাজ করানো হয়। অথচ এক টাকা বেতন নেই। কোনো হাজিরা নেই। সরদার যেমনে পারছে তেমনি আমাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। আমাদের বলার জায়গা নেই। আমরা কার কাছে বলব। আমরা রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করি। এ টাকার ভাগ সরদারকে দিই। কোনো কোনো সময় ওয়ার্ড বয়রাও টাকা দাবি করে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সরদার দেলোয়ার (বিক্রমপুর) যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা মাঝেমধ্যে স্পেশাল বয়দের কাছ থেকে টাকা নিই। তবে আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ সঠিক নয়।
সরকারি ট্রলির বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে কেন টাকা নেয়া হয় এর কোনো সদুত্তর দেননি তিনি।’ আলম ওরফে ভাগিনা আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কে অভিযোগ করেছে তার নামটা বলেন। এরপর তিনি বলেন, আমি এসব টাকা খাই না। এসব হয়তো অন্যরা নেয়।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার আবুল হোসেনকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

হাসপাতালের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার একেএম নাছির উদ্দিনের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পুনরায় ঢামেক হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর একাধিকবার ফোন করেও ঢামেকের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একজন সহকারী পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/30163