চট্টগ্রাম নগরীতে যানজটে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন নগরবাসী। ছবিটি গতকাল দুপুরে চকবাজার এলাকার
২১ মার্চ ২০১৮, বুধবার, ১০:২৬

বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী যানজট

অবর্ণনীয় দুর্ভোগ

যানজট নিত্যসঙ্গী হয়ে পড়েছে বন্দর শহর চট্টগ্রামের মানুষের। যানজটের নিত্যাবনতি চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে গন্তব্যে ছুটে চলা মানুষকে। ফলে যানজট এক দিকে যেমনি মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির করে তুলছে, অন্য দিকে পথেই নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। পোহাতে হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।
খোদ সরকারদলীয় নেতা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সিএমপির উপকমিশনারের (ট্রাফিক উত্তর) সাথে সাক্ষাৎ করে বলেছেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলছে অসহনীয় যানজট, চরম ভোগান্তিতে নগরবাসী। যানজটের কারণে মানুষের নাকাল হয়ে ওঠার মতো অবস্থা। নগরীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আজ যানজটের কবলে। যানজটের কবলে পড়ে মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অমূল্য শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে ট্রাফিক সিস্টেম অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে নগরীর কর্নেলহাট থেকে অলঙ্কার মোড়, নিমতলা বিশ্বরোড থেকে বড়পুল, সল্টগোলা রেলক্রসিং থেকে সিইপিজেড মোড়, ২নং গেট থেকে অক্সিজেন মোড়, মুরাদপুর থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বহদ্দারহাট থেকে নতুন ব্রিজ, প্রবর্ত্তক মোড় থেকে চকবাজারসহ নগরীর অন্য সড়কগুলোতে সারা দিন যানজট লেগেই থাকছে। কোনোভাবেই এ যানজটকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যানজটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে নিয়মিত অফিস যাত্রা, স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের অনুপস্থিতি লেগেই আছে। বিমানযাত্রীরা দুর্ভোগে পড়ছে সবচেয়ে বেশি। প্রায়ই সময় মতো বিমান ধরতে পারছে না বিমানযাত্রীরা। অ্যাম্বুলেন্স এবং লাশবাহী গাড়িও আটকা পড়ছে প্রতিনিয়ত। দুর্ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রতিদিনকার রুটিন যানজটের কারণে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে।

গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দুপুর ১২টায় বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে শুরু করে নিমতলা বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত রাস্তায় গাড়ি যেন এগোচ্ছেই না। যে যেখানে আছেন সেখানেই গরমে জবুথবু। সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের এ পথ পার হতে যানবাহনগুলোর সময় যাচ্ছে অন্তত এক ঘণ্টা।
দুপুর ১২টায় নগরীর ব্যস্ততম জিইসি মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় শুধু গাড়ি গাড়ি। কোনো দিকেই যেন কেউ যেতে পারছেন না। জিইসি মোড়ের এ যানজট গিয়ে থেমেছে পশ্চিমে জাকির হোসেন রোডের রেল ক্রসিং পার হয়ে আরো পরে। জিইসি মোড় ফেলে দুই নম্বর গেটের অবস্থা আরো করুণ। নিত্যদিনই এ স্পটে মানুষকে নাকাল হতে হচ্ছে যানজটের কবলে পড়ে।
নগরীর প্রধান এ সড়কে যানজটে মানুষের নাকাল অবস্থা হলেও জনগণের বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার এবং মুরাদপুর ফ্লাইওভার ছিল একেবারেই ফাঁকা।
দুপুর নাগাদ নগরীর চকবাজার মোড় পার হতেই যানবাহনগুলোর প্রতিদিনই যানজটে পড়ে সময় যাচ্ছে প্রায় আধা ঘণ্টার বেশি। এ ধরনের নিত্য যানজটের চিত্র চোখে পড়ে বিভিন্ন গলিপথেও।
নগরীতে যানজট নিরসনের কথা বলে ইতোমধ্যে তিনটি ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। যেসব ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে সেসবের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ সরকারি মহলেই।
অন্য দিকে নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ফ্লাইওভার নির্মান যানজটের কোনো সমাধান নয়। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ছাড়া যানজট নিরসন করা যাবে না। তাদের মতে, যদি বিকল্প সড়ক সৃষ্টি করা না যায় তবে কোনো কাজ হবে না। তা ছাড়া ফ্লাইওভার একবার নির্মাণ করে ফেললে প্রধান সড়কের পরিবহন ব্যবস্থার (এমআরটি) ভবিষ্যৎ প্রয়োজন ব্লক হয়ে যায়।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে এ মুর্হর্তে চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসনে মাস্টারপ্ল্যানে উল্লিখিত কয়েকটি নতুন সড়ক নির্মাণ জরুরি। সড়ক প্রস্তুত থাকলে তো এর ওপর ফ্লাইওভার যখন প্রয়োজন হবে তখন করা যাবে। কিন্তু তা না করে সিডিএ ফ্লাইওভারে হাত দিচ্ছে। অথচ উন্নত বিশ্ব এখন ফ্লাইওভার কনসেপ্ট থেকে সরে আসছে বলেও সূত্র জানায়।
সূত্র মতে, একটা জংশনে ঘণ্টায় পাঁচ হাজার যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করলে গোল চক্কর ও ঘণ্টায় সাড়ে আট হাজার যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করলে চ্যানেলাইজড জংশন তৈরি করতে হবে। এর বেশি চলাচল করলে তখন ফ্লাইওভারের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। অথচ সিডিএ কর্তৃক নির্মিতব্য মুরাদপুর লালখান বাজার ফ্লাইওভার প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদনেই উল্লেখ রয়েছে, এ ফ্লাইওভার দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার ১২৭টি গাড়ি চলাচল করবে। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে কেবল একটি রাস্তা রয়েছে। এ একটি রাস্তার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আরো নতুন নতুন রাস্তা করতে হবে। তবেই যানজট নিরসনে কার্যকর সমাধান আসবে।

এ দিকে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের মতে, বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীতে যে হারে গাড়ি চলাচল করছে সে হারে রাস্তাঘাট নির্মিত হয়নি। উন্নয়নকেন্দ্রিক রাস্তাঘাট সংস্কারের কারণেও যানজট হচ্ছে। তা ছাড়া নগরীতে কোনো নির্দিষ্ট ট্রাক কিংবা বাস টার্মিনাল নেই। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং তার অন্যতম একটি কারণ। আর যেসব গাড়ি যত্রতত্র রাস্তায় পার্কিং করা থাকে সেসব গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে রাখার জন্য কোনো ডাম্পিং ইয়ার্ডও নেই। অথচ চট্টগ্রাম হচ্ছে বাণিজ্যিক এবং বন্দরনগরী। বন্দরকেন্দ্রিক শত শত গাড়ি প্রতিদিন চট্টগ্রাম নগরীতে প্রবেশ করে আবার বের হয়। সিইপিজেড, কেইপিজেডসহ বিভিন্ন সংস্থার বিপুল গাড়িও প্রতিদিন নগরীতে চলাচল করে কিন্তু দুঃখের বিষয় এত বিপুল গাড়িকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো পর্যাপ্ত সার্জেন্ট কিংবা ট্রাফিক পুলিশ বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীতে নেই।

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/303571