২০ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫১

খাদ্য নিরাপত্তার পূর্বশর্ত গণতন্ত্র

ড. মাহবুব উল্লাহ্

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি প্রতিযোগিতামূলক হয়নি, অংশগ্রহণমূলকও হয়নি। এর ফলে নির্বাচনটি যে ত্রুটিপূর্ণ হয়েছিল সে ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই। বাংলাদেশ যে আর্থসামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে, এটাকে মোটা দাগে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই বলা যায়। তবে এ পুঁজিবাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে একাডেমিক বিতর্ক হতে পারে। সুষ্ঠু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রাণশক্তি হল প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাহীন পুঁজিবাদ একচেটিয়া পুঁজিবাদে অধঃপতিত হয় এবং সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে প্রচুর অপচয় হয় এবং উৎপাদনের সম্ভাবনা ও বিকাশের পথেও অন্তরায় সৃষ্টি হয়। ফলে একপর্যায়ে এ ধরনের পুঁজিবাদ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে এবং এর অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দানা বেঁধে ওঠে। সুষ্ঠু পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অপরিহার্য শর্ত যেমন প্রতিযোগিতা, ঠিক তেমনি এর রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপরিহার্য শর্তটি হল আবারও প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান শর্ত হল বহুদলীয় ব্যবস্থা এবং বহুবাচনিকতা (Pluralism)। এ বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র বহুলাংশে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছে। এ কারণেই বিখ্যাত ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন Economic Intelligence Unit থেকে ধার করা পরিভাষায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আখ্যায়িত করেছে ‘হাইব্রিড গণতন্ত্র’। এরপর থেকে শাসক মহলের বক্তৃতা-বিবৃতিতে একটি নতুন প্রবণতা দেখা দিল। এদের মতে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে উন্নয়নই অগ্রাধিকার পাবে। অর্থাৎ উন্নয়ন আগে এবং গণতন্ত্রের বিবেচনা আসবে তার পর। এ বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় শাসক মহলের ব্যক্তিরা জনসমর্থনের ওপর প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত বলতে লাগলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। দেশে এখন উন্নয়নের জোয়ার বইছে। এসব প্রচার-প্রচারণার ফলে চাপা পড়ে গেল সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি- কত ব্যয়ে উন্নয়ন? স্বাভাবিকভাবেই প্রতিযোগিতাহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা থাকে না। ফলে দুর্নীতি ও অপচয় খুব গভীরে শিকড় বিস্তার করে। এর ফলে উন্নয়ন তার শক্তি হারিয়ে ফেলে, টেকসই হতে পারে না, জনগণকে দিতে পারে না কাক্সিক্ষত ফল।

সময়ের সঙ্গে উন্নয়নের লক্ষ্য ও কৌশল পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির পরপর উন্নয়ন ডিসকোর্সে প্রাধান্য অর্জন করেছিল কৃষি খাত। কীভাবে বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর করে তোলা যায়, সেটাই ছিল সব অর্থনীতিসংক্রান্ত আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অব্যবহিত পর দেশের জনসংখ্যা ছিল বর্তমান জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম। কিন্তু তদসত্ত্বেও জনসংখ্যার চাহিদানুযায়ী খাদ্যশস্য উৎপাদন সম্ভব হচ্ছিল না। খাদ্যশস্যের দিক থেকে বড় রকমের ঘাটতি ছিল। অভুক্ত-অর্ধভুক্ত জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন ছিল বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ অত্যন্ত নগণ্য পরিমাণ হওয়ার ফলে বিদেশ থেকেও খাদ্যশস্য আমদানি করা সম্ভব হচ্ছিল না। বিপুল খাদ্য ঘাটতির ফলে খাদ্যশস্যের দাম ক্রমেই বাড়তে থাকে। ১৯৭৪-এ পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রকট হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষের হাতে ক্রয়-ক্ষমতা ছিল না। ১৯৭৪-এ পরপর তিনবার বন্যা হয়। এ বন্যার ফলে কৃষিসংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানও উবে যায়। একদিকে খাদ্যশস্যের অগ্নিমূল্য, অন্যদিকে কাজ না পাওয়ার ফলে গরিব বেকার মানুষ প্রচণ্ড বিপাকে পড়ে গেল। তাদের পক্ষে খাদ্যশস্য ক্রয় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ছিল না বললেই চলে। ফলে ভূমিহীন মানুষ কিছুতেই খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য টাকা-পয়সা রোজগার করতে পারছিল না। এ পরিস্থিতিকে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তার তাত্ত্বিক ভাষায় Failure in exchange entitlements বলে উল্লেখ করেছিলেন। অমর্ত্য সেনের কথাটির বাংলায় অর্থ দাঁড়ায়, বিনিময় স্বত্বের ব্যর্থতা। শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষ বেঁচে থাকতে পারে কেবল তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করে। শ্রমশক্তি বিক্রয়ের মাধ্যমে যে মজুরি পাওয়া যায় তা দিয়েই শ্রমজীবী মানুষ তার ভরণপোষণের জন্য খাদ্যশস্য ক্রয় করে।

আলোচিত বিশ্লেষণ অনুযায়ী ১৯৭৪-এ লক্ষ-কোটি মানুষের হাতে কোনো ক্রয়ক্ষমতা অবশিষ্ট ছিল না। সেই সময় জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, সংকটের এ ভয়াবহতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পাট চাষে লুপ্তপ্রায় অবস্থা। পাট চাষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সাধারণ ফসলের তুলনায় এটি অনেক বেশি শ্রম আত্মস্থ করে। সব মিলিয়ে শ্রমবাজারের বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়েছিল বিশাল জোগানের মুখে অতি স্বল্প চাহিদা। এ সংকট থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ। সরকারি হিসাবে এ দুর্ভিক্ষে ২৬ হাজারের কিছু বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। অমর্ত্য সেনের গবেষণা থেকে বোঝা যায়, গণমৃত্যুর সংখ্যায় বাংলার ইতিহাসে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তরের পর এখন পর্যন্ত একমাত্র ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।’
বাংলাদেশে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলেই অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। এখন দেশে এবং দেশের বাইরে তুলনামূলকভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বেশকিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশাল অঙ্কের রেমিটেন্স-প্রবাহ গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্রয়ক্ষমতা সৃষ্টি করেছে। ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থার ফলে প্রান্তিক মানুষ কিছু উৎপাদনশীল কাজ করতে পারছেন। জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হলেও ফসল উৎপাদনের নিবিড়তা প্রায় তিনগুণ হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধা ব্যবহার করে বোরো ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে বোরো ফসলই সবচেয়ে বড় ফসল। বোরো ফসলের সুবিধা হল এটি বন্যা মৌসুমবহির্ভূত ফসল হওয়ায় এর উৎপাদনে অনিশ্চয়তা অন্য ফসলের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া কৃষি উৎপাদনের বহুমুখীকরণের ফলে গম, ভুট্টা, আলু এবং চেনা-অচেনা অনেক ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হচ্ছে। ফলের চাষ, মাছের চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামারের উদ্ভব ঘটেছে। জমি সংকুচিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রথম আমলের তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি কৃষি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। ১৯৭৪-এ এদেশের মানুষ একটি বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছিল। প্রাণ বাঁচানোই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এ রকম বৈরী পরিস্থিতি এ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে টিকে থাকার অদম্য স্পৃহার জন্ম দেয়। এ অদম্য স্পৃহা ও টিকে থাকার শক্তি থেকেই বর্তমানের সাফল্যের উদ্ভব। কিন্তু এখনও ক্ষুধাকে সম্পূর্ণভাবে জয় করা সম্ভব হয়নি। বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। ক্ষুধা ও অপুষ্টি আরও বেশকিছু সময় আমাদের ভোগাবে। তার প্রমাণ বিগত কয়েক বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন ও আমদানির চিত্র থেকে পাওয়া যায়।

দেশের প্রধান দুই খাদ্যশস্য চাল ও গমের উৎপাদন গত অর্থবছর কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দুই খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছে ৩ শতাংশ। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসেই চাল ও গমের আমদানি বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। উৎপাদন ঘাটতির মধ্যেই রোহিঙ্গাদের বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে কিছুটা বাড়তি খাদ্যশস্যের প্রয়োজন। তবে আমদানি যে পরিমাণে বেড়েছে তা অস্বাভাবিকই বলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হয় উৎপাদনের পরিসংখ্যানে গরমিল আছে, অথবা আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে। গত বছর হাওরের বন্যার ফলে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতির মুখে চাল উৎপাদনে টান পড়ে। ব্লাস্টের কারণে গম উৎপাদনও হয়নি কাক্সিক্ষত পরিমাণে। ফলে এ দুই খাদ্যশস্যের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিবিএসের তথ্যানুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছর চাল ও গম উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ টন। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ৫৭ হাজার টন। অর্থাৎ গত অর্থবছর প্রধান দুই খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছে সাড়ে ৯ লাখ টন। খাদ্যশস্যের আমদানিনির্ভরতা ক্রমাগত অব্যাহত থেকেছে। ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ (জুলাই-জানুয়ারি) খাদ্যশস্যের আমদানি যথাক্রমে ১৬.২০, ১০.৪৪, ২০.৯১, ২৪.৭৩, ২৪.৪৫, ৩৬.৩৭ ও ৬৮.৪০ লাখ টন। অন্যদিকে একই সময়ে খাদ্যশস্যের উৎপাদন সর্বনিম্ন ৩.৪৮ কোটি থেকে ৩.৬৮ কোটি টন (লক্ষ্যমাত্রা) পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাফল্য তেমন উজ্জ্বল নয়। আমদানিনির্ভরশীলতা থেকেই যাচ্ছে।

যা হোক, সুষ্ঠু নীতিনির্ধারণে সঠিক পরিসংখ্যানের কোনো বিকল্প নেই। খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে স্থবিরতা থেকেই যাচ্ছে। খুঁজে বের করতে হবে কেন এই স্থবিরতা। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিরাট সাফল্যের কাহিনী প্রচারিত হলেও সরকারের পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। আবার ঘাটতির অজুহাতে আমদানির নামে অর্থ পাচারও কাম্য নয়। খাদ্যশস্য আমদানিতে অতীতে সময়মতো পদক্ষেপ না গ্রহণেরও অভিযোগ আছে। ফলে বাজারে উত্তাপ বেড়েছে। এখনও সেই উত্তাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে দারিদ্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। উন্নয়নের বিশাল চিৎকারের মুখে খাদ্য নিরাপত্তার চিত্রটি আদৌ আকর্ষণীয় নয়। এর একটা বড় ব্যাখ্যা হতে পারে জবাবদিহিতার অভাব। অমর্ত্য সেন খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা সমাধানে গণতন্ত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। গণতন্ত্রকে সঠিক ও স্বাভাবিক পথে চলতে দিলে বিদ্যমান সমস্যার মধ্যে হয়তো পড়তে হতো না। আশা করি, সংশ্লিষ্ট সব মহল বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/29428