১৯ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৯:২৮

চড়া মাশুল গুনছেন ব্যবসায়ীরা

চট্টগ্রামে দুই শিপিং এজেন্সির বিরোধের ভয়াবহ মাশুল গুনতে হচ্ছে আমদানিকারক তথা ব্যবসায়ীদের। সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি শিপিং কোম্পানি ফার শিপিং লাইনস লিমিটেড নামে নতুন এজেন্সি নিয়োগ দেয়ায় ক্ষুব্ধ পুরনো এজেন্সি সি-মেরিন শিপিং লাইনস আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। আর এ কারণে ওই কোম্পানির (ফার শিপিং) ৫টি জাহাজ থেকে কোনো ধরনের কনটেইনার নামানো যাচ্ছে না। ১৫ দিন থেকে এক মাস ধরে জাহাজগুলো আমদানিপণ্য ভর্তি ৬ হাজারেরও বেশি কনটেইনার নিয়ে সাগরে ভাসছে। এতে একদিকে আমদানিকারকদের ঘাড়ে চাপছে কোটি কোটি টাকার ডেমারেজ চার্জ। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল যথাসময়ে না পাওয়ায় অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে রফতানি পোশাক শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে। পোশাকের অনেক রফতানি আদেশ বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দুই দিকেই লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে আমদানিকারক ও শিল্প মালিকদের। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার জাহাজগুলো থেকে কনটেইনার নামানোর অনুমতি দেয়া হলেও উচ্চ আদালতের সেই আদেশের সার্টিফাইড কপি ও কাস্টমসের ছাড়পত্র পেতে আরও ২-৩ দিন সময় লেগে যেতে পারে । বিরোধের বিষয়ে ২১ মার্চ পূর্ণাঙ্গ শুনানির কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পুরনো ও নতুন যে দুই শিপিং এজেন্সির মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে সেই দুটির মালিক আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতা। নতুন করে কোনো এজেন্সি নেয়া কিংবা মামলার কারণে এভাবে হাজার হাজার কনটেইনার আটকে গেলে যে দেশের অর্থনীতির এবং আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে সে বিষয়টি তারা কেউই এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করেননি। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে।

জানা গেছে, সিঙ্গাপুরভিত্তিক শিপিং কোম্পানি ফার শিপিং লাইনস লিমিটেডের স্থানীয় (এ দেশীয়) এজেন্সি ছিল সি-মেরিন শিপিং লাইনস লিমিটেড। গত ৩১ জানুয়ারি সি-মেরিনের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ফার শিপিং লাইনসের। এ কারণে ফার শিপিং লাইনস নতুন করে মার্কো শিপিং নামের আরেকটি শিপিং এজেন্সির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু সিী-মেরিনের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানিপণ্য ভর্তি কনটেইনার নিয়ে ৫টি জাহাজ এলেও জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোর প্রক্রিয়া করতে যায় নতুনভাবে চুক্তিবদ্ধ হওয়া মার্কো শিপিং। কিন্তু পুরনো শিপিং এজেন্সি সি-মেরিন এতে আপত্তি জানায়।

সূত্র জানায়, কাস্টমসের আইন অনুযায়ী নতুন এজেন্সিকে দায়িত্ব পালন করতে হলে পুরনো ও নতুন এজেন্সি দুটিকেই যৌথ ঘোষণা দিতে হয়। মার্কো শিপিং কাগজপত্র দাখিল করলে আপত্তি নিষ্পত্তি করতে সি-মেরিনের প্রতিনিধিকে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ডাকলেও তারা না এসে আদালতের শরণাপন্ন হয়। আদালতকে তারা জানায়, নিয়মবহির্ভূতভাবে ফার শিপিং লাইনস নতুন এজেন্সি নিয়োগ দিয়েছে। দুই শিপিং এজেন্সির এ বিরোধে ঝুলে যায় জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোর প্রক্রিয়া।
যে পাঁচটি জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো যাচ্ছে না সেগুলো হল- এমভি টিআর আরামিস, এমভি ক্যাপ্যারাক্সস, এমভি চার্লি, এমভি ক্যাপ ওরিয়েন্ট ও এমভি থরস্কাই। এর মধ্যে এমভি টিআর আরামিস বন্দরের বহির্নোঙরে আসার পর কনটেইনার খালাস করতে না পেরে এটি প্রায় ২৮ দিন ধরে ভাসছে সাগরে। কোনো জাহাজ ১৫ দিন ধরে ভাসছে সাগরে। কোনোটি এক মাস ধরে। পাঁচটি জাহাজে ৬ হাজারেরও বেশি কনটেইনার রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব জাহাজে চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলার দেড় হাজার প্রতিষ্ঠানের আমদানিপণ্য ভর্তি কনটেইনার রয়েছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, জাহাজ কোম্পানির মূল মালিক বা প্রিন্সিপ্যাল চাইলে এজেন্সি বদল করতেই পারেন। তবে তা করতে হবে আইন মেনে। কোনো ধরনের বিরোধ না রেখে। আমি যতদূর জানি দুই শিপিং এজেন্সির বিরোধ উচ্চ আদালতে গড়িয়েছে। উচ্চ আদালত ২১ মার্চ পূর্ণাঙ্গ শুনানির তারিখ নির্ধারণ করে এই সময়ের মধ্যে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোর একটি অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছেন। সেই আদেশের সার্টিফাইড কপি পেতে হয়তো আরও দু-এক দিন সময় লেগে যাবে। কিন্তু এরই মধ্যে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়ে গেল তার দায় নেবে কে? জাহাজ বন্দরে ভেড়ার পর নির্ধারিত সময়ে কনটেইনার না নামলে বা ডেলিভারি নেয়া না গেলে প্রতি কনটেইনারের বিপরীতে জ্যামিতিক হারে বিপুল অঙ্কের ডেমারেজ চার্জ দিতে হয়।

বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি ও বর্তমান বন্দর ও শিপিং সাব-কমিটির চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘দুই শিপিং এজেন্সির বিরোধে ভিকটিম হয়ে গেল নিরপরাধ ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও পোশাক শিল্প মালিকরা। এ ধরনের জটিলতায় ব্যবসায়ীরা লোকসানের শিকার হলে ক্ষতিপূরণ কার কাছে চাইবে কিংবা আদৌ চাইতে পারবে কিনা তার কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। তাই সরকারের উচিত এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ও ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য আইন করা। আইনের সংস্কার করা। কারণ এটা শুধু কোনো একক ব্যবসায়ী, আমদানিকারক বা শিল্পপতির ক্ষতি না, এটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষতি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে ৫টি জাহাজে কনটেইনার আটকে আছে সেখানে পোশাক শিল্প মালিকদেরও বিপুলসংখ্যক কনটেইনার রয়েছে। কনটেইনারে রয়েছে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল। যথাসময়ে ওই কাঁচামাল না পেলে অনেক কারখানার রফতানি আদেশ বাতিল হবে।’

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে বন্দর ও শিপিং সাব-কমিটির আহ্বায়ক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, ‘সবেমাত্র উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে আসতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪২ বছর। দীর্ঘ সাধনায় যে অর্জন সেটা ধরে রাখা যাবে না- যদি বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানো নিয়ে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি তৈরি হয়। কনটেইনার জট ও জাহাজ জট দীর্ঘায়িত হয়।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/29181