১৯ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৯:২৭

এক বছরে কর্মসংস্থান কমেছে এক লাখ

সরকারি হিসাবে দেশে প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সরকারি বিনিয়োগও। কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না কর্মসংস্থান। তবে বাড়ছে বেকার মানুষের সংখ্যা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় এক লাখ। পাশাপাশি এ এক বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তিবিষয়ক প্রতিবেদনে (২০১৬-১৭) উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রতিবেদনটি আজ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে বিবিএস। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এ অর্থবছরে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ১৩ লাখ, যা আগের বছর ছিল ১৪ লাখ। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুরোপুরি বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৬০ হাজার, যা আগের
অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ছিল ২৬ লাখ। এর আগের ৩ বছর বেকারের সংখ্যা স্থির ছিল বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
তবে বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, জরিপের পদ্ধতিগত কারণে বিবিএসের প্রতিবেদনে বেকার সংখ্যা কম হয়েছে। এ পদ্ধতি শিল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য।

বেকার বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিবিএস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, ব্যক্তি খাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না হওয়া, সরকারি বিনিয়োগের মানহীন প্রশ্নবিদ্ধ খরচ এবং শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে এমনটি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবৃদ্ধির হিসাবে কর্মসংস্থান মেলানো কঠিন। যেখানে প্রতি বছর প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, তার আগের অর্থবছরের চেয়ে এমনকি লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। কিন্তু তার কোনো প্রতিফল কর্মসংস্থানে পড়ছে না। তাছাড়া সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও যেভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে, তা মানসম্মত হচ্ছে কিনা- সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ খুব কম হচ্ছে। যেটা হচ্ছে, সেটা হয়তো পুরনো যন্ত্রপাতি রিপ্লেসমেন্ট করা হচ্ছে। তাহলে সেটি তো কর্মসংস্থান বাড়াচ্ছে না। এক্ষেত্রে শিল্পের সম্প্রসারণ তো হচ্ছে না। এর বাইরে নতুন বিনিয়োগ যেগুলো আসছে সেগুলোর বেশির ভাগই অটোমেশন হচ্ছে। ফলে শ্রম নিবিড়তা না থাকায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না।

বিবিএসের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম রোববার যুগান্তরকে বলেন, বেকার সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও বাড়তে পারে। কিন্তু কর্মসংস্থান কমার কোনো কারণ নেই। কেননা আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে, বেসরকারি বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত হারে না বাড়লেও কিছুটা বেড়েছে, কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, বিদেশে লোক যাওয়ার হার বেড়েছে, পোশাক ও কৃষি খাতেও খুব বেশি অটোমেশন হয়নি। তাহলে কর্মসংস্থান ১ লাখ কমবে কিভাবে? শুধু তথ্য দিলেই হবে না, এ বিষয়ে বিবিএসকে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলা উচিত কোন খাতে কেন কর্মসংস্থান কমেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বেকার সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ হতে পারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। কেননা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের কারণে যে পরিমাণ মানুষ কর্মের বাজারে আসছেন, সে তুলনায় কর্মসংস্থান দেয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে সারা দেশের ১ লাখ ২৩ হাজার পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করে শ্রমশক্তি সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এর আগে প্রতি তিন মাস অন্তর ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হলেও গত বছর থেকে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। বিবিএসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিন মাসের তথ্য প্রকাশ করে এতে বিভ্রান্তি তৈরির সুযোগ থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুলনামূলক বেকার সংখ্যা বাড়লেও শ্রমশক্তি বৃদ্ধির হার একই রয়েছে অর্থাৎ ৪ দশমিক ২ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম মেনে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপেও দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনেও ছিল বেকার ২৬ লাখ। এ হিসাবে গত কয়েক বছরে বেকার মানুষের সংখ্যার কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু এবারই প্রথম প্রায় ৬০ হাজার বেকার বাড়ার তথ্য মিলেছে। এ জরিপে এক ঘণ্টা কেউ কাজ করলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয়নি। ১৫ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যে পুরোপুরি বেকার ২৬ লাখ ৬০ হাজার হলেও যারা কাজ করতে চায় বা এক মাসের মধ্যে কাজের খোঁজ করেছিল, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি রয়েছে। শ্রমশক্তির বাইরে যারা রয়েছে তাদের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, এদের অধিকাংশই গৃহিণী, তারপরই রয়েছে শিক্ষার্থী, বয়স্ক বা অবসরে যাওয়া মানুষ, ভবঘুরে কিংবা যারা পরিবারের অতি আদরের সন্তান। যাদের বেকার হিসেবে ধরা হয়নি।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইমপ্লয়মেন্ট রিসার্সের চেয়ারপারসন রুশিদান ইসলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিবিএসের প্রতিবেদনে বেকারত্ব যেভাবে মাপা হয় (আইএলওর নিয়মে) সেটি বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। সেটি হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য। এজন্যই বেকার সংখ্যা এত কম দেখানো হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। কারণ এখন অনেক জায়গায় পুঁজি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহার তো আর বাদ দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে যেটি করতে হবে সেটি হচ্ছে কর্মের জায়গা বাড়াতে হবে। অর্থাৎ একটি কারখানায় যদি প্রযুক্তির কারণে ১০ জন লোক কাজ হারায়, তাহলে তারা যেন অন্য একটি নতুন কারখানায় কাজ পেতে পারে। বা নতুন নতুন কারখানা বা কর্মের জায়গা যদি সৃষ্টি হয়, তাহলে প্রযুক্তি ও পুঁজির ব্যবহার বাড়লেও দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

বিবিএসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বেকারের মধ্যে শিক্ষিত ও নারী বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া টাকা ছাড়াই পরিবারে মহিলারা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি শ্রম দিচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। নারীর তুলনায় পুরুষের কর্ম যুক্ত হওয়ার হার বেড়েছে। এছাড়া মজুরির মধ্যেও পুরুষ-নারীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে একজন পুরুষ যা আয় করে নারী তার চেয়ে কম আয় করে থাকে। পরিবারে টাকা ছাড়া যেসব কাজ করা হয় তার মধ্যেও রয়েছে নারী-পুরুষের বৈষম্য।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঘরে নারীরা রান্নার কাজ করেন কিন্তু পুরুষরা সাধারণত সেটি করেন না। আর কাপড়-চোপড় ধোয়ার কাজ নারীরাই বেশি করেন। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ পুরুষরা করলেও তার সংখ্যা খুবই সামান্য। তারা করে খুব কম। বাচ্চা ও বয়স্কদের দেখাশোনার কাজ বেশির ভাগ মহিলারাই করেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/29175