১৯ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৯:২৫

গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী

গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটি হবে ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত- এমন মন্তব্য করেছেন দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। তাদের মতে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে প্রতিযোগী সক্ষমতা হ্রাস পাবে। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর। দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, মানুষ বিদেশি পণ্য কেনার দিকে ঝুঁকবে। সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়বে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর।

আবাসিক ছাড়া শিল্পকারখানাসহ সব খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে বিতরণকারী কোম্পানিগুলোকে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে।
রোববার যুগান্তরকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলে তা হবে আত্মঘাতী। এমনিতে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতির হার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ধরে রাখা মোটেই সম্ভব হবে না। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।

তিনি আরও বলেন, আগামী মাসে এলএনজি আসার সম্ভাবনা আছে। এখনও কিন্তু ব্যবসায়ীরা এর সুফল পাননি। কিন্তু এলএনজির দাম বেশি বলে এখন গ্যাসের দাম বাড়ানো যৌক্তিক হবে না। এলএনজির সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের মিশ্রণের পর তার দাম কত হবে, তা আগে ব্যবসায়ীদের জানানো দরকার। মনে রাখতে হবে, একজন উদ্যোক্তা শিল্প স্থাপন করেন অনুমানের ভিত্তিতে। হুটহাট করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে উদ্যোক্তাদের খেলাপির সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ সঠিক নয়। কারণ বর্তমানে অনেক কারখানায় গ্যাস নেই, থাকলেও চাপ কম। এ অবস্থায় দাম বাড়ানো মোটেই শিল্পের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে না। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে শিল্প বিকাশের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, সেটিকে বাধাগ্রস্ত করবে।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এমনিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। তার ওপর গ্যাসের দাম শতভাগ বাড়ানো হলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাবে। দাম বাড়ানোর আগে অবশ্যই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। এলএনজি এলে গ্যাসের দাম বাড়বে- এটা ব্যবসায়ীরা জানে এবং মেনে নেবে। কিন্তু তাই বলে শতভাগ বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না। স্থানীয় গ্যাসের সঙ্গে এলএনজির মিশ্রণের পর উৎপাদন খরচ কত হয়- সে বিষয়টি অবশ্যই খোলাসা করা উচিত।
ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, এখন গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে শিল্পের ওপর নতুন চাপ পড়বে। শিল্পের স্বার্থে এলএনজিকে প্রণোদনা দিয়ে বর্তমান গ্যাসের দামের মতো রাখা উচিত। তা সম্ভব না হলে গ্যাসের দাম নির্ধারণের আগে অবশ্যই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। তবে যাই হোক, শিল্পে গ্যাসের দাম শতভাগ বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না।

রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, এ বছরটি বিভিন্ন কারণেই ব্যবসায়ীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সামনে জাতীয় নির্বাচন, এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, শ্রমিকদের মজুরি বোর্ড গঠন ও নানামুখী আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম সময়োপযোগী হবে না। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। কিন্তু এ কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো উন্নত দেশগুলোয় পাওয়া ডিউটি ফ্রি, কোটা ফ্রি’র মতো সুবিধাগুলো সংকীর্ণ হয়ে আসবে। এর প্রভাব পোশাক রফতানিতে পড়তে পারে। আবার শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে বোর্ড গঠন করা হয়েছে, সেখান থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসবে। যাতে পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। সামগ্রিকভাবে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা কমছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিল্প টিকিয়ে রাখাতেই উদ্যোক্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না।

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী মাসের ২৬ তারিখ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। এর আগেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। ইতিমধ্যে গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলোকে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে কোম্পানিগুলো প্রস্তাব পাঠাবে। ইতিমধ্যে কোম্পানিগুলো প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। বিইআরসি প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেবে।

জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও সার কারখানায় ২০০ শতাংশ করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্য শিল্পকারখানা, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজিসহ অন্য খাতগুলোয় ৪০-১০০ শতাংশ দাম বাড়ানো হতে পারে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে আবাসিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ হচ্ছে ৩.১৬ টাকা। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়লে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম দিতে হবে ৯.৪৮ টাকা। এ খাতে উৎপাদিত গ্যাসের ৪১ শতাংশের বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। সার কারখানায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য দাম দিতে হয় ২.৭১ টাকা। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম পড়বে ৮.১৩ টাকা। উৎপাদিত মোট গ্যাসের প্রায় ১০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় সার কারখানায়। আর শিল্প-কলকারখানায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ হচ্ছে গড়ে ৭.৭৬ টাকা। এ খাতে প্রস্তাব অনুযায়ী ১০০ শতাংশ বাড়ানো হলে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য উদ্যোক্তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে ১৫.৫২ টাকা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/29173