১৯ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৯:২১

উন্নয়ন বনাম ঘাটতি

আশিকুল হামিদ : সরকারের প্রচারণার বদৌলতে উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে চলা দেশকে এরই মধ্যে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতির কবলে পড়তে হয়েছে। অন্য সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে যেদিন ‘উন্নয়নশীল’ দেশের সার্টিফিকেট দিয়েছে, সেদিনই- গত ১৭ মার্চ পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলারের দাম ৮২ টাকা ধরে টাকার অংকে ৮৩ হাজার কোটিরও বেশি। রিপোর্টে আরো জানা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ পরিমাণের ঘাটতি। স্বাধীনতার পর দেশ কখনো, কোনো অর্থবছরেই এত বিপুল পরিমাণ ঘাটতির কবলে পড়েনি। তথ্যটি নিজের হালনাগাদ রিপোর্টে জানিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে পর্যন্ত ২০১০-১১ অর্থবছরের ঘাটতিকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বলে মনে করা হতো। সেবার ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৯৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। এর পরের অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৩২ কোটি ডলার। কিন্তু ওই দুটিই ছিল পুরো অর্থবছরের ঘাটতি। অন্যদিকে এবার অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই পরিমাণের দিক থেকে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, অবিলম্বে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেয়া হলে বছরের বাকি পাঁচ মাসে মোট ঘাটতির পরিমাণ কল্পনার বাইরে চলে যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকাশিত সকল খবরে রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানির ব্যয়বৃদ্ধিকে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন ভারসাম্যের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আলোচ্য সময়ে আমদানির জন্য যেখানে তিন হাজার ১১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে সেখানে রফতানি আয় হয়েছে দুই হাজার ১০৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এই সময়ে আমদানির জন্য ব্যয় বেড়েছে ২৫ দশমিক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে রফতানি আয় বেড়েছে মাত্র সাত দশমিক ৩১ শতাংশ। ফলে চলতি হিসাবে ঘটতি অনেক বেশি হয়েছে। অথচ উন্নয়নশীল দেশকে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত রাখতে হয়। অন্যদিকে বিগত কয়েক বছরে উদ্বৃত্ত থাকলেও চলতি অর্থবছরে তা ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। জানুয়ারির পরও ঋণাত্মক এই ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং অর্থবছরের বাকি পাঁচ মাসে ঘাটতির পরিমাণও অনেক বেড়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। ঘাটতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা বলেছেন, আমদানি ব্যয়ের তুলনায় একদিকে রফতানি আয় বাড়েনি, পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহও নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেবাখাতের ঋণাত্মক অবস্থা। একযোগে চলছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ এবং মেট্রোরেলসহ আরো কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। এসব কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানির বিষয়টি চলবে আরো কয়েক বছর। সে তুলনায় রফতানি বাড়ার যেহেতু সম্ভাবনা নেই সেহেতু দেশের ঘাটতির পরিমাণও কেবল বেড়েই যাবে।

একই কারণে পরিমাণগত দিক থেকে আমদানি-রফতানির ভারসাম্যে বড় ধরনের পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ ঘাটতি বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি সাহায্য ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়েছে, বিদেশের সঙ্গে লেনদেনেও দেশকে চাপ ও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এভাবে ঘাটতি বাড়তে থাকলে আমদানি-রফতানির ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না, প্রচন্ড চাপের মুখে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেড়ে যাবে এবং টাকার অবমূল্যায়ন করতে হবে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতিও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে। বাড়বে চাল-ডালসহ প্রতিটি পণ্যের দাম। এভাবে স্বল্পসময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক সংকটে পড়বে। নাভিশ্বাস উঠবে সাধারণ মানুষের।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বাণিজ্য ঘাটতি সংক্রান্ত তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানা গেছে, বিপুল এই ঘাটতির পেছনে যথারীতি প্রধান ভূমিকা রয়েছে ভারতের। প্রতিবেশি দেশটি থেকে আমদানি লাফিয়ে বাড়লেও নানা ধরনের শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের রফতানি বাড়তে পারছে না। প্রসঙ্গক্রমে জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের দেয়া তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করা যায়। মাস কয়েক আগে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ আট গুণ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছিল ১৭ হাজার ১৫২ কোটি টাকার পণ্য। একই সময়ে ভারতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল দু’ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যবধান তথা বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় আট গুণ।
এমন অবস্থার কারণ জানাতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীসহ তথ্যাভিজ্ঞরা ভারতের নীতি ও কার্যক্রমকে প্রতারণাপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। কারণ, প্রকাশ্যে আমদানি বাড়ানোর এবং ঘাটতি কমিয়ে আনার ঘোষণা দিলেও ভারত সুকৌশলে এমন কিছু শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্ক বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে এবং এখনো করে চলেছে যার ফলে রফতানির সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার পরও বাংলাদেশ থেকে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ভারত থেকে নানা ধরনের অসংখ্য পণ্য আসছে বাংলাদেশে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো জানিয়েছে, ভারত থেকে যেখানে দু’ হাজার ৮৬ ধরনের পণ্য আসছে বাংলাদেশ সেখানে মাত্র ১৬৮ ধরনের বেশি পণ্য রফতানি করতে পারছে না। নিজেদের শিল্প সংরক্ষণের অজুহাত দেখিয়ে ভারত বাংলাদেশের ৭৫০ ধরনের পণ্য নিষিদ্ধ করেছে। ভারত সেই সাথে এমন ৪৫০টি পণ্যের জন্য ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যেগুলোর ৯৮ শতাংশই বাংলাদেশ উৎপাদন করে না। বৈধ বাণিজ্যের পাশাপাশি চোরাচালানের পথেও বিপুল পরিমাণ পণ্য ঢুকে পড়ায় ঘাটতি শুধু বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভারতের সঙ্গে শুধু বৈধ বাণিজ্যেই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যেও বাংলাদেশ পিছিয়েই রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পাশাপাশি রয়েছে অন্য কিছু বিশেষ কারণ। যেমন রফতানির জন্য কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে প্রথমেই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। তাছাড়া খাদ্যদ্রব্য শুধু নয়, বহু ধরনের বিলাস সামগ্রী আমদানির কারণেও বাংলাদেশের ঘাটতি বেড়ে চলেছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে বেড়ে চলা ঘাটতির মধ্যে থাকতে হলে উন্নয়নশীল দেশ হওয়া শুধু কাগুজে বিষয় হয়ে থাকবে। সাধারণ হারে সমৃদ্ধি অর্জন করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। এজন্যই বেশি দরকার এখন ঘাটতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা। এজন্য বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে রফতানি আয় বাড়ানোর ব্যাপারে- বিশেষ করে ভারতে রফতানি বাড়াতে হবে। এ উদ্দেশ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের উচিত চোরাচালান প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া। কারণ বৈধ বাণিজ্যের চাইতে কয়েকশ’ ভাগ বেশি বাণিজ্য ভারত চোরাচালানের পথে করে থাকে। সুতরাং সীমান্তে কঠোর অভিযানের মাধ্যমে চোরাচালান প্রতিরোধ করা গেলে ভারতের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়বে। ভারত তখন বাংলাদেশের প্রতি নীতি-মনোভাব পরিবর্তন না করে পারবে না। এর ফলে দেশের রফতানি বাড়বে বহুগুণ। অন্য সব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যেও রফতানি বাড়ানোর একই নীতি অবলম্বন করা দরকার। আমদানির ক্ষেত্রেও জাতীয় শিল্পের স্বার্থে কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এমন সব পণ্য আমদানি করতে দেয়া চলবে না যেগুলো বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়।

বলা দরকার, ভারতসহ বিশ্বের সব দেশই এভাবে নিজেদের শিল্প ও পণ্যকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এর ফলে একদিকে জাতীয় শিল্পের বিকাশ ঘটবে অন্যদিকে দেশের আমদানি ব্যয়ও অনেক কমে আসবে। এসবের সঙ্গে রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর জন্য সরকারকে রেমিট্যান্স আয় এবং বিদেশি ঋণ ও সাহায্যের প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর এবং আমদানি ও রফতানির মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখবে না। অন্য সব দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতিবিদসহ দেশপ্রেমিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

 

http://www.dailysangram.com/post/323184