১৮ মার্চ ২০১৮, রবিবার, ১০:১৩

টাকার জোরে 'মৃত্যু' হয় অপমৃত্যুর

হয় না ময়নাতদন্ত কিংবা মামলা

চট্টগ্রামের হালিশহর টোল রোডে বন্ধুদের নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক সোলায়মান আলম শেঠের ছেলে উমায়ের আলম শেঠ। গাড়ির ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই মারা যান ভ্যানচালক মো. মানিক। ১ মার্চ রাতের ওই ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি, লাশের ময়নাতদন্তও করেনি পুলিশ। একজন মানুষের মৃত্যু ঘটলেও পুলিশ টাকার বিনিময়ে ঘটনাটির 'নিষ্পত্তি' করে দিয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে।


ঘটনাটি স্বীকার করে হালিশহর থানার ওসি মাহফুজুর রহমান সমকালকে বলেন, মৃত ব্যক্তির পরিবার মামলা করেনি। এ জন্য ওই ঘটনায় কাউকে আটকও করা হয়নি। ওসির দাবি, স্বজনের 'আবেদনে' ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। মানবিক বিবেচনায় সোলায়মান শেঠ ভ্যানচালকের পরিবারকে কিছু টাকা দিয়েছেন।


সোলায়মান আলম শেঠ সমকালকে বলেন, পরিবারটি গরিব। মামলা করবে না বলে লিখিত দিয়েছে। এ জন্য তিনি মানবিক দিক বিবেচনা করে প্রথমে দাফনের জন্য ৫০ হাজার টাকা দেন। পরে আরও দুই লাখ টাকা দেন। দুর্ঘটনার পর তা সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ মীমাংসা করে দিয়েছে।

তবে ঢাকার উত্তরায় এক কিশোরের মৃত্যুর পর অপমৃত্যু মামলা ও ময়নাতদন্ত হওয়ার পরও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে 'অপমৃত্যু' নিষ্পত্তি করে দিয়েছে পুলিশ। ওই কিশোরের বাবা বলছেন, তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে; তাকে থানায় ডেকে নিয়ে জোর করে টাকা দিয়ে মীমাংসা করা হলেও তিনি বিচার পাননি।

শুধু ঢাকার উত্তরা বা চট্টগ্রামের এ দুটি ঘটনাই নয়- দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্ঘটনা, আত্মহত্যাসহ নানা ধরনের অপমৃত্যুর পর মামলা হচ্ছে না, লাশের ময়নাতদন্তও হচ্ছে না। তদন্ত ছাড়াই পুলিশ স্থানীয়ভাবে এসব অপমৃত্যুর ঘটনা নিষ্পত্তি করে দিচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানই বলছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে সারাদেশে ১ হাজার ৫৫৫টি অপমৃত্যুর ঘটনা পুলিশ স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি করেছে। একই পরিসংখ্যান বলছে, ওই সময়ের মধ্যে অপমৃত্যু মামলার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়ে ৬০৬টি প্রতিবেদন সংশ্নিষ্ট থানায় এসেছে। প্রতিবেদনমতে, এর মধ্যে ১৮টি হত্যাকাণ্ড।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৬০০ অপমৃত্যুর ১৮টিতে হত্যার আলামত পাওয়া গেলেও বাকি ঘটনাগুলোতে পুলিশের তদন্ত আর ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে- সে কারণে বোঝা যাচ্ছে না, ঘটনাগুলো আসলেই অপমৃত্যু নাকি হত্যা। স্থানীয়ভাবে বেশি নিষ্পত্তি হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা, নৌ দুর্ঘটনা অথবা কলকারখানায় বিদ্যুৎস্পর্শে শ্রমিকের মৃত্যু, ছাদ থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিক বা অন্য কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু, গৃহকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং পারিবারিক কলহে আত্মহত্যার মতো ঘটনা। পুলিশের মাধ্যমে একটি 'অস্বাভাবিক মৃত্যুর' এমন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের কাছ থেকে 'এ ঘটনায় মামলা করব না' বা 'ময়নাতদন্ত করতে চাই না' বা 'আমার কোনো অভিযোগ নেই'- এমন মুচলেকা রাখা হয়। বিবাদী পক্ষের কাছ থেকে রাখা হয় মুচলেকা।

যদিও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো দুর্ঘটনা বা অপমৃত্যুর ক্ষেত্রেই লাশের ময়নাতদন্ত করা, মামলা করা এবং তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আদালতকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের ঘটনা পুলিশ কোনোভাবেই নিষ্পত্তি করতে পারে না।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আত্মহত্যা করেছেন বলে নিশ্চিত জানা গেলে, কারও দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি- স্থানীয় তদন্তে এমনটি নিশ্চিত হলে এবং কোনো পক্ষের কোনো দাবি না থাকলে অপমৃত্যুর ঘটনাগুলো স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি করা হয়। এ ছাড়া নানা দুর্ঘটনায় স্বজনদের অভিযোগ না থাকলে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিষ্পত্তি করা হয়।

অবশ্য ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৭৪ ধারায় বলা হয়েছে, 'আত্মহত্যা ইত্যাদি সম্পর্কে পুলিশ অনুসন্ধান করবে এবং প্রতিবেদন দেবে।'

মানবাধিকার কর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কথিত এসব নিষ্পত্তির ঘটনার নেপথ্যে অবৈধ অর্থের লেনদেন থাকে। সাধারণত প্রভাবশালীরা অভিযুক্ত হলে এমন মীমাংসা হয়। এতে ঘটনার শিকার ব্যক্তি আইন অনুযায়ী যেমন ক্ষতিপূরণ পান না, তেমনি দোষী ব্যক্তির বিচারও হয় না। তদন্ত না হওয়ায় নেপথ্যের ঘটনাও থাকে আড়ালে।

জানতে চাইলে ফৌজদারি অপরাধ বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ূয়া সমকালকে বলেন, স্থানীয়ভাবে অপমৃত্যুর মীমাংসা করার পুরো প্রক্রিয়াটিই ঝাপসা। আদালতকে পাশ কাটিয়ে পুলিশ এটা করতে পারে না, সে এখতিয়ারও নেই।

উদাহরণ দিয়ে এ আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, একজন শ্রমিক কাজ করার সময় ভবন থেকে পড়ে গেলেন। পুলিশ খবর পেয়ে ভবনের নিচ থেকে তার লাশ উদ্ধার করল। এখন তাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করতে পারে, আবার নির্মাণাধীন বাড়ির মালিক বা ঠিকাদার নির্মাণকাজের সময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না নেওয়ায় ওই শ্রমিক মারা যেতে পারেন। তদন্ত ছাড়া তো ওই শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য শুরুতে অপমৃত্যু মামলা ও ময়নাতদন্ত করতে হবে এবং মামলার ভিত্তিতে পুলিশের তদন্ত করতে হবে। এর আগে পুলিশ কোনো ঘটনার নিষ্পত্তি করতে পারে না।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, কারও অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে থানায় অপমৃত্যু মামলা হবে। পুলিশ লাশের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করবে। মামলার তদন্তের ভিত্তিতে এবং ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপর পুলিশ সিদ্ধান্ত নেবে। এর আগে তো এ ধরনের ঘটনা পুলিশ নিষ্পত্তি করতে পারে না।

ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিষ্পত্তি ১৫শ' ঘটনার :আত্মহত্যা বা অন্যভাবে অপমৃত্যুর ১ হাজার ৫৫৫টি ঘটনা পুলিশ স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি করেছে। গত বছরের শেষ তিন মাসে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব ঘটনা নিষ্পত্তি করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ৪৮টি অপমৃত্যুর ঘটনা স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি করে পুলিশ। একই সময়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ১৯টি, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ ছয়টি, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ ১৬২টি, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ ৩৫টি, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ ৫টি অপমৃত্যুর ঘটনা স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি করে। এ ছাড়া ঢাকা রেঞ্জের বিভিন্ন থানায় ১৫৩টি, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর রেঞ্জের বিভিন্ন থানায় যথাক্রমে ১১৭টি, ৯৬টি, ৩২টি, ৪১০টি, ৪৩টি, ১৩৬টি এবং ২৪৫টি অপমৃত্যুর ঘটনা নিষ্পত্তি করে পুলিশ। ময়নাতদন্ত ছাড়াই রেলে কাটা পড়া ৪৮টি লাশের ঘটনাও স্থানীয়ভাবেই নিষ্পত্তি করে দেয় পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অনেক দুর্ঘটনা আছে যাতে মৃত ব্যক্তির স্বজনরা মামলা করতে চান না। তারা স্বজনের কাটাছেঁড়াও (ময়নাতদন্ত) করাতে চান না। তখন পুলিশ বাধ্য হয়ে ঘটনাগুলোর মীমাংসা করে দেয়। সে ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের মুচলেকা রাখা হয়।

ময়নাতদন্তের চেয়ে নিষ্পত্তি বেশি খুলনা রেঞ্জে :পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ১০টি জেলায় সবচেয়ে বেশি অপমৃত্যুর মামলা স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে। আলোচিত তিন মাসে খুলনা অঞ্চলের ১০ জেলায় আত্মহত্যা ও অন্যান্যভাবে ৭২২টি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৪১০টি অপমৃত্যুর মীমাংসা স্থানীয়ভাবে পুলিশ করে দেয়। ৩১২টি অপমৃত্যুর মামলায় মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। ওই সময়ের মধ্যে মাত্র ৫৫টি ঘটনার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের হাতে আসে। যার ৮টি ঘটনাকেই হত্যা হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক।

ময়নাতদন্ত ছাড়াই এত বেশিসংখ্যক ঘটনার নিষ্পত্তির কারণ জানতে চাইলে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ সমকালকে বলেন, কেউ আত্মহত্যা করলে তার বাবা-মা যদি বলেন, এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই, তারা আইনগত ব্যবস্থা নিতে চান না- তখন ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। স্থানীয়ভাবে ঘটনাটি মীমাংসা করে দেওয়া হয়। কোনো সন্দেহ থাকলে অবশ্যই ময়নাতদন্ত করা হয়।

মীমাংসার পর এলাকাছাড়া! :গত ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ১০/বি নম্বর রোডের মাথা থেকে মো. আসিব নামে ১৬ বছরের এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, ৬/এ নম্বর রোডের নির্মাণাধীন ২১ নম্বর বাড়ির ছাদে ওই কিশোর তার দুই বন্ধুর সঙ্গে ছিল। সেখান থেকে 'পড়ে গেলে' বাড়ির মালিকের ছেলে ও দারোয়ান তাকে ১০/বি নম্বর রোডে ফেলে রাখে। আসিবের বাবা কামাল শেখ শুরু থেকেই তার ছেলেকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছিলেন। তবে পুলিশ সে অভিযোগে কান না দিয়ে তিন দিন পর থানায় অপমৃত্যু মামলা নেয়। পুলিশ তাকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। পরে মীমাংসার নামে অভিযুক্ত বাড়ির মালিকের মাধ্যমে তাকে চার লাখ টাকা দেয়।

কামাল শেখ পেশায় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের আবদুল্লাহপুরের একটি টিনশেড বাড়িতে তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন। কথিত মীমাংসার পর অভিযুক্ত বাড়ির মালিকের হুমকিতে এখন তিনি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

কামাল শেখ সমকালকে বলেন, 'চোর' ভেবে তার ছেলেকে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর সড়ক দুর্ঘটনার নাটকও সাজানো হয়। তিনি বারবার পুলিশকে তা বলেছেন। তিনি হত্যা মামলা করতে চাইলেও পুলিশ তার কাছ থেকে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে বলেছে, আত্মহত্যা মামলা হয়েছে। তাকে থানায় ডেকে নিয়ে পুলিশ ছেলের 'হত্যাকারী'দের সঙ্গে বসিয়ে দেয়। বলে, 'ঝামেলা করে লাভ কী? মীমাংসা করে ফেলেন।'

কামাল শেখের ভাষ্য, এরপর বিবাদী পক্ষ ছেলের লাশ দাফনের জন্য তার হাতে চার লাখ টাকা দেয়। পুলিশ বলে টাকা নিয়ে নেন। আসামিরাও তাকে হুমকি দেয়। প্রকৃতপক্ষে ছেলে হত্যার বিচার পাননি তিনি।

জানতে চাইলে উত্তরা-পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন সমকালকে বলেন, ওই ঘটনায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে কিশোর আসিবের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তিনি দাবি করেন, বাড়ির মালিক আসিবের বাবাকে টাকা দিয়ে মীমাংসা করেছেন কি-না তা তার জানা নেই।

http://samakal.com/bangladesh/article/18031140