১৮ মার্চ ২০১৮, রবিবার, ৯:৫৬

ধুঁকছে পুরনোগুলো, নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে না

বন্দরে কমছে না কনটেইনারের চাপ * আমদানি-রফতানি বাড়লেও ৯ বছরে হয়নি নতুন কোনো আইসিডি

নানা সংকটে নতুন বিনিয়োগ আসছে না প্রাইভেট আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) খাতে। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারের চাপ কমাতে বেসরকারি পর্যায়ে আইসিডি স্থাপনের অনুমতি দেয়ার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ ধরনের ২০টি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর মধ্যে দুটি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আর বাকিগুলোর অধিকাংশই ব্যবসায়িকভাবে ধুঁকতে থাকায় এ খাতে নতুন বিনিয়োগে কেউ এগিয়ে আসছে না। অথচ প্রতিবছর চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং বৃদ্ধি হচ্ছে প্রায় ১৩ শতাংশ হারে। সেই তুলনায় প্রাইভেট আইসিডি না বাড়ায় বন্দরে প্রায়ই লেগে থাকছে কনটেইনার জট। আবার যেসব আইসিডি আছে এর অধিকাংশতেই প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট না থাকায় পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের হয়রানিতে পড়তে হয়। গুনতে হয় ডেমারেজ চার্জ। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম এখন অনেকটাই প্রাইভেট আইসিডিগুলোর ওপর নির্ভরশীল। রফতানি পণ্যের প্রায় শতভাগ প্রাইভেট আইসিডিতে কনটেইনারজাত করার পর বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় জাহাজীকরণের জন্য। অপরদিকে আমদানি পণ্যের প্রায় ২৫ শতাংশ প্রাইভেট আইসিডির মাধ্যমে হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। প্রাইভেট আইসিডিগুলো যদি কয়েক ঘণ্টা কিংবা একদিন বন্ধ থাকে তাহলে অনেকটা অচল হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। চার্জ বৃদ্ধির প্রতিবাদে গত ৫ মার্চ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কনটেইনার ডিপোগুলো থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ রাখে ট্রাক, ট্রেইলার ও কাভার্ড ভ্যান মালিকরা। এতে আটকা পড়ে বিপুল পরিমাণ আমদানি ও রফতানি পণ্য। সময়মতো আইসিডি থেকে বন্দরে কনটেইনার পাঠাতে না পারায় প্রায় এক হাজার কনটেইনারের শিপমেন্ট বিলম্বিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় ১০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে, যা ২০১৬ সালে এসে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রায় ২৫ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে বলে আশা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ বন্দর দিয়ে যে হারে আমদানি-রফতানি বাড়ছে, সেই হিসেবে এ মুহূর্তে অন্তত আরও ২০টি আইসিডি প্রয়োজন। কিন্তু পুরনো আইসিডিগুলোর অধিকাংশই ব্যবসায়িকভাবে ধুঁকতে থাকায় এ খাতে বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না আগ্রহীরা। তারা বলছেন, একটি কনটেইনার ডিপো করতে বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে চালু আইসিডিগুলো বিনিয়োগ অনুপাতে মুনাফা করতে পারছে না। কিছু কিছু আইসিডি লাভের মুখ দেখলেও অন্যগুলো কোনোভাবে টিকিয়ে রেখেছে অস্তিত্ব। আবার চট্টগ্রাম বন্দরের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে যেসব আইসিডি আছে সেসব আইসিডি সরিয়ে নেয়ার জন্য বন্দরের ১১তম বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরের বোর্ডসভায় সে সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়। তাই বন্দরের ২০ কিলোমিটারের ভেতরে নাকি বাইরে আইসিডি স্থাপন করা যাবে এ নিয়েও রয়েছে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, প্রাইভেট আইসিডি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আরও অন্তত ২০টি আইসিডি প্রয়োজন। নতুন আইসিডি না হলে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট বাড়বে। ব্যাহত হবে আমদানি-রফতানি। দীর্ঘদিন কনটেইনার বোঝাই পণ্য আটকে থাকলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়, তার প্রভাব ভোক্তা পর্যায়েও পড়ে। তাই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে আরও নতুন আইসিডি স্থাপন করতে হবে এবং এ খাতে আগ্রহীদের উৎসাহ জোগাতে হবে।

এ খাতে নতুন বিনিয়োগ না আসা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সচিব রুহুল আমিন শিকদার যুগান্তরকে বলেন, যারা এর মধ্যে এ ব্যবসায় এসেছেন, তারা তেমন একটা লাভ করতে পারছেন না। ২০টি আইসিডির মধ্যে লোকসানের মুখে ২টি বন্ধ হয়ে গেছে। চার থেকে ৫টি লোকসানের মধ্যে রয়েছে। বাকিগুলো লাভের মুখ দেখলেও তা বিনিয়োগের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এ কারণে অনেকের আগ্রহ থাকলেও সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা চিন্তা করে এ খাতে বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছেন না। তিনি জানান, একটি বেসরকারি আইসিডি করতে স্থান, ইনস্ট্র–মেন্ট, লোকবলসহ সব মিলিয়ে অন্তত ৫শ’ কোটি টাকার প্রয়োজন। এই টাকা ঋণ নেয়া হলে প্রতি মাসে কেবল সুদই দিতে হয় ৬ কোটি টাকার মতো। তা ছাড়া শ্রীলংকা, ভারত ও সিঙ্গাপুরের চেয়ে আমাদের কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ অনেক কম। তাই বিদ্যমান আইসিডিগুলো যে আয় করছে তা দিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কারণে নতুন করে আইসিডি স্থাপন করতে আগ্রহী হচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।

সূত্র জানায়, ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে ওসিএল নামের একটি কনটেইনার ডিপো চট্টগ্রামে বেসরকারি পর্যায়ে প্রথম কনটেইনার হ্যান্ডলিং শুরু করে। এরপর ১৯৯৮ সালে আইসিডি নীতিমালা হলে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিকভাবে এসব আইসিডি শুধু খালি কনটেইনার রাখত। ২০০৩ সাল থেকে রফতানিমুখী কনটেইনার এবং ২০০৬ সাল থেকে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার হ্যান্ডলিং শুরু করে। বেসরকারি ২০টি আইসিডির মধ্যে কালুরঘাটের ইকবাল এন্টারপ্রাইজ ও পতেঙ্গার সামুদ্যায়া আইসিডি লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ১৮টি বেসরকারি আইসিডি চালু রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এসব আইসিডির ধারণক্ষমতা রফতানি কনটেইনারের ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ হাজার টিইইউএস (টোয়েন্টি ফিট ইক্যুভেলেন্ট কনটেইনার) এবং আমদানি কনটেইনারের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০ হাজার টিইইউএস। সর্বশেষ ২০০৮ সালে কেডিএস ও নেমসেন নামক দুটি আইসিডি স্থাপিত হয়। এরপর নতুন আর কোনো আইসিডি আসেনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/28676