১৭ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৮:৩৭

২০ দলীয় জোটের অবরোধে যানবাহনে পেট্রোল বোমা হামলার যত ঘটনা

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ ছিল ২০১৫ সালের আলোচিত। এর আগে ওই জোটের আহ্বানে ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর “মার্চ ফর ডেমোক্রেসি” নানা কায়দায় ভ-ুল করে দেয় তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা। গৃহবন্দী হয়ে পড়া ২০ দলীয় জোট নেত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সরকারের দমন-পীড়ন থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে ওই দিন থেকেই টানা অবরোধের ডাক দেন। ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের সাথে যোগ দিয়ে জনতা অবরোধ কর্মসূচি পালন শুরু করে। অনির্দিষ্টকালের টানা অবরোধ শান্তিপূর্ণভাবে চলতে চলতে তা দিন থেকে সপ্তাহ, সপ্তাহ থেকে মাস পেরিয়ে মাসের পর মাস চলতে থাকায় অচল হয়ে পড়েছিল গোটা বাংলাদেশ। এ অবস্থায় ২০ দলীয় জোটের ওপর কালিমা লেপনে তৎপর হয়ে ওঠে তৎকালীন সরকারসহ তার রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র। ওই তৎপরতার মধ্যেই সারাদেশজুড়ে শুরু হয় যানবাহনের ওপর হামলা, ভাংচুর ও পেট্রোল বোমা মেরে আগুন দেয়ার নির্মম বিভৎস ঘটনা। একের পর এক এসব ঘটনা ঘটিয়ে সারাদেশে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়। আর কেড়ে নেয়া হয় অগনিত তাজা প্রাণ। দোষ বর্তায় ২০ দলীয় জোটের ওপর। সরকার এসব ঘটনাকে পুঁজি করে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা জুড়ে দেয়। সেই প্রক্রিয়ার একটি ফলই বেগম জিয়াকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাস পোড়ানোর মামলায় হুকুমের আসামী করে।
কুমিল্লার সেই ঘটনা নিয়ে যত কথা

কুমিল্লার বাস পোড়ানোর মামলায় খালেদা জিয়ার আটকাদেশের পর সচেতন জনতা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম বেছে নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা তাদের প্রতিক্রিয়াসহ কুমিল্লার বাস পোড়ানোর ঘটনা নিয়ে নানা মন্তব্যজুড়ে দেন। তাদের দাবি হচ্ছে, ওই ঘটনার পেছনে আসল রহস্য লুকিয়ে আছে। কি সেই রহস্য? তার চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো: বিএনপির অবরোধ চলাকালে ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দিবাগত রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় আইকন পরিবহনের একটি বাস পেট্রোলবোমা হামলা হয়, যাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ৭ জন এবং দগ্ধ হয় ২৩ জন যাত্রী। এই ঘটনায় বেগম খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামী করে মামলা দায়ের করে থানা পুলিশ। অথচ তার একমাস আগ থেকেই বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন তার কার্যালয়ে গৃহবন্দী। পুলিশ ওই ভবন ঘেরাও করে রাখে, কাউকে ঢুকতে ও বের হতে দেয়নি, এমনকি খাদ্যদ্রব্যও ঢুকতে দেয়নি, গ্যাস পানি বিদ্যুত‘র লাইন টেলিফোন লাইন কেটে দেয়, জ্যামার লাগিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়। মোট কথা, কারাগারের চেয়েও খারাপ অবস্থায় বিরাজ করে। এ অবস্থার মধ্যে ঘটে কুমিল্লায় বাসে পেট্রোল বোমাহামলার ঘটনা। আর এর জন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করা হয়েছে।
সেদিনের ঘটনাবলী : মাসখানেক ধরে চলা অবরোধে অনেক ঘটনা ঘটলেও বৃহৎ ৫টি পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনা জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে। এগুলো হল : ওই বছরের ১৫ জানুয়ারি রাতে বিজিবি-র পাহারায় ঢাকা আসার পথে রংপুরের মিঠাপুকুরে খলিল পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে বোমা হামলায় ৫ জন নিহত এবং ২৩ জন আহত। ২৩ জানুয়ারি গ্লোরি পরিবহনের একটি বাস ঢাকা থেকে নরসিংদী যাওয়ার পথে রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কাঠের পুলের কাছে পেট্রোল বোমায় আক্রান্ত হয়ে ৩০ জন অগ্নিদগ্ধ হয়। আহত একজনের বরাত দিয়ে সে সময় দৈনিক কালেরকণ্ঠ প্রকাশ করে, ঘটনার সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একটি পুলিশের গাড়ি, যা পরে ব্যবহার হয় আহতদের হাসপাতালে নিতে।
৩ ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে কক্সবাজার থেকে ঢাকার পথে আইকন পরিবহনের একটি বাস কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় পেট্রোল বোমা হামলায় আক্রান্ত হয়। এতে ঘটাস্থলেই নিহত হয় ৭ জন এবং দগ্ধ হয় ২৩ জন যাত্রী। কুমিল্লার পুলিশ সুপারের ভাষ্যমতে (ঘটনার পর), বাসটি ১১০ কিলোমিটার বেগে চলছিল। আর একজন আহত যাত্রীর সাক্ষাৎকারে ৭১ টিভি প্রকাশ করে, হামলার পরপরই তিনি পাশে পুলিশ দেখেছেন, কিন্তু তারা কোনো প্রকার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ওই সময়ে টিভির টকশোর জনপ্রিয় আলোচক সাবেক এমপি মেজর আকতারউজ্জামান তার সেনাবাহিনী লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে ব্যাখ্যা করেন, ১১০ কিলোমিটার বেগে চলন্ত গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করা কোনো সাধারণ মানুষের হাত দ্বারা সম্ভব নয়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা সাবেক আমলা এইচ টি ইমাম ওই সময়ে বলেছেন এটা সামরিক বাহিনীর মত (দক্ষ) কারও নিখুঁত কাজ, যাতে ব্যবহার করা হয়েছিল ফসফরাস!

৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় গাইবান্ধায় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের পাহারায় চলমান নাফু পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধ ৫ জন নিহত, এবং আহত হয় আরো ৩০ জন।
৭ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১১টায় ময়মনসিংহ শহরের টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশের সামনেই যাত্রীবাহী একটি বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় তিন যাত্রী দগ্ধ হয়।

লক্ষণীয় যে, উল্লিখিত ৫টি পেট্রোলবোমা হামলার প্রতিটি ঘটনায় আশে পাশে ছিল পুলিশ বাহিনী, কিন্তু কোনো দুষ্কৃতিকারীকে হাতে নাতে পাকড়াও করতে দেখা যায়নি, এমনকি এক রাউন্ড গুলিও চালায়নি, যদিও এর প্রতিটি ঘটনা ছিল মারাত্মক ফৌজদারী অপরাধ।
২০১৫ সালের চলমান বিরোধী দলের অবরোধের মধ্যেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পেট্রোলবোমাসহ, এমনকি গাড়িতে অগ্নিসংযোগকালে সরকারি দলের নেতাকর্মীকে হাতে নাতে আটক করেছে পুলিশ। কিন্তু সরকারি দলের পরিচিতি প্রকাশ পাবার পরেই ওই সব নেতাকর্মীদেরকে পুলিশ ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে কয়েকটি ঘটনা হচ্ছে: ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনী এলাকার যুবলীগ কার্যালয় থেকে ১০টি পেট্রোলবোমা উদ্ধার করে পুলিশ। অন লাইন নিউজ পোর্টাল ‘শীর্ষ নিউজ’, ৮ ফেব্রুয়ারি এ খবর প্রকাশ করে। ৪ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ছানাব এলাকায় ভুলতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেনের একটি ঝুটের গোডাউনে বোমা বানানোর সময় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নেতা রহমতউল্লাহসহ চারজন নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হন। আহতদের রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতাল ও স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিস্ফোরণের ঘটনার পর পরই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতারা ঘটনাস্থলে এসে বিস্ফোরণের আলামত সরিয়ে ফেলেন। এ খবর যুগান্তর ৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করে।

৪ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথ দীঘি ইউনিয়নের কেসকি মোড় এলাকা থেকে পেট্রোলবোমাসহ মানিক ও বাবুল নামে দুই যুবলীগের নেতাকে আটক করে পুলিশ, কিন্তু পরে ছেড়ে দেয়। (শীর্ষ নিউজ ৪ ফেব্রুয়ারি)
৪ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুর ২টার দিকে কুষ্টিয়ার মিরপুরে পেট্রোলবোমাসহ ছাত্রলীগের এক নেতাকে পুলিশ আটক করে। পরে অজ্ঞাত কারণে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। (আমার দেশ ৭ ফেব্রুয়ারি)
৩ ফেব্রুয়ারি রাতে র্যা বের অভিযানে চট্টগ্রামের টাইগার পাস রেলওয়ে কলোনী থেকে ৯টি পেট্রোলবোমা, ২টি ককটেল, ৭টি কিরিচ, ২টি রামদা, ৯টি লোহার পাইপসহ ছয় ব্যক্তি আটক হয়। ঘটনার মূল হোতা মুন্না স্বীকার করে, সে নিহত যুবলীগ নেতা হুমায়ুন কবির মুরাদের ছোট ভাই এবং সে নিজেও আ’লীগ করে। (ইত্তেফাক, ৪ ফেব্রুয়ারি)
২৫ জানুয়ারি ফেনী শহরের টেলিফোন ভবন থেকে ৭টি পেট্রোলবোমাসহ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিমের ভাতিজা আজিম উদ্দিনকে আটক করে পুলিশ। (দিনকাল ২৫ জানুয়ারি)

১০ জানুয়ারি বেলা সোয়া ২টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ৩টি হাতবোমা বিস্ফোরণ হয়। এতে জড়িত থাকার অভিযোগে হাতে নাতে গ্রেফতার হয় সাদিক নামে এক আ’লীগ কর্মী, যদিও পরে পুলিশ ছেড়ে দেয়। (যুগান্তর, ১১ জানুয়ারি)
এর আগে ১ জানুয়ারি রাত পৌনে ৮টার দিকে মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালি কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে পেট্রোল দিয়ে বাসে আগুন দেয়ার কালে ৩ ছাত্রলীগ কর্মী আটক হয়, যার মধ্যে ছিল জেলা ছাত্রলীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সাজ্জাদ মোল্লা, ছাত্রলীগ কর্মী লিমন, ও রানা। এদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় পেট্রোল ভর্তি দু’টি বোতল ও দিয়াশলাই। (বাংলাদেশ প্রতিদিন ২ জানুয়ারি ২০১৫)
১০ ফেব্রুয়ারি দুপুর ৩টার বগুড়ায় ককটেল বানানোর সময় বিস্ফোরণে সোহাগ (২২) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর ডান হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। আহত সোহাগ বগুড়া সদর উপজেলার গোকুল ইউনিয়নের বড়ধাওয়া গ্রামের সফিকুল ইসলাম সফিকের ছেলে এবং স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি গণি’র ভাতিজা। (শীর্ষ নিউজ)

ওই সময়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান স্বীকারোক্তি করেছেন, পেট্রোলবোমা সরবরাহকারী ছাত্রলীগ। দেশের বেসরকারি টেলিভিশন সময় টিভির ‘সম্পাদকীয়’ টকশোতে ওই সময়ের একদিন (শুক্রবার) রাতে তিনি অকপটে বলেন, ‘ছাত্রলীগের যাদের পেট্রোলবোমাসহ ধরা হয়েছে তারা সোজা বাংলায় ব্যবসায়ী। এরা পেট্রোলবোমা বানায়, এবং বানিয়ে বিক্রি করে, ব্যবসা করে। মানুষ মারার কন্ট্রাক্ট নেয়, যে এইখানে বাসে বোমা মারলে এত টাকা। মানুষ মারলে এত টাকা।’

অন্যদিকে, মহাজোট সরকারের অন্যতম এমপি মাইনুদ্দিন খান বাদল ৭১ টিভি সংযোগ অনুষ্ঠানে ৬ ফেব্রুয়ারি জানান, ‘২০ দলের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কর্মকা- হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছে মহাজোট সরকার, এ ক্ষেত্রে যা যা করা দরকার সবই করতে সক্ষম হয়েছেন।’ সচেতন জনতার অভিমত, সে সময়ের চলমান অবরোধের মধ্যে পেট্রোলবোমায় নাশকতার কার্যকরণ নিয়ে এরপরে আর আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই?”

 

http://www.dailysangram.com/post/322869