১৬ মার্চ ২০১৮, শুক্রবার, ৮:১২

রাজনীতিতে ভোট উধাও কাম্য নয়!

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : জনগণের ভোটের অধিকার এমনি এমনিতে আসেনি। অনেক ত্যাগ, কষ্ট ও সংগ্রামের বিনিময়ে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেও তা আজ বিশ্বব্যাপী ভূলন্ঠিত। একটা সময় তো বৃটিশ বেনিয়ারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিলেও তা আজ শুধুই ইতিহাস। সে ইতিহাস কারো অজানা নয়! বৃটিশরা যখন বিশ্ব শাসন করতো তখন তারা এমন একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করেছিল যে, সেখানে সর্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না। যারা কর প্রদান করতো এবং শিক্ষিত ছিল তারাই কেবল ভোট দিতে পারতো। পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকেও কিছুদিন সেই ব্যবস্থা চালু ছিল। পরবর্তীকালে তীব্র গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সে অধিকারও আইয়ুব খান কেড়ে নিয়েছিল। জনগণ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সে অধিকার আদায় করলেও ভোটের রায় কার্যকর হতে না দেয়ার ফলশ্রুতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উত্থান হয়। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই এদেশের মানুষ জীবনের রক্তটুকু বিলিয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি। অথচ সে ভোট আজ উধাও হয়ে গেছে। জনগণের আশা ছিল যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আর সংগ্রাম করতে হবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকারটুকু ক্ষমতাসীন শাসকেরা নিশ্চিত করেনি। যে ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে ভোটাধিকার আজ পুলিশের বুটের নিচে নিষ্পেষিত। আর এ কারণেই আমার ভোট আমি দিব যাকে খুশি তাকে দিব এই স্লোগান এখন মৃতপ্রায়।
দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে ভোট কার্যত উধাও হয়ে গেছে। কি ব্যবসায়ী সংগঠন, কি আইনজীবীদের প্রতিনিধি নির্বাচন, কি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন, কি পরিবহন সমিতির নির্বাচন। এককথায় বলতে গেলে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নির্বাচনের যতগুলো সংগঠন রয়েছে তার সিংহভাগ থেকেই ভোট উধাও। রাজনৈতিক দলের ভোটাভুটির কথা না হয় বাদই দিলাম। দেশের ব্যবসায়ী সংগঠন থেকেও কার্যত ভোট উধাও হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা এখন আর নিজ নিজ সংগঠনের নেতা নির্বাচনের সুযোগ পান না। জেলা পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের সংগঠন জেলা চেম্বারগুলোর অধিকাংশ কমিটি হয়েছে ভোটাভুটি ছাড়াই। ওই সংগঠনগুলোতেও কমিটি হচ্ছে সরকারের চাপিয়ে দেয়া আজ্ঞাবহ লোকদের দ্বারা। সব মিলিয়ে দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো ব্যবসায়ীদের সংগঠন থেকেও নির্বাচনের প্রতিযোগিতা বিদায় নিয়েছে অজানা গন্তব্যে। পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে সারা দেশের ৬৪টি জেলা চেম্বারের মধ্যে ৪৭টিতে সর্বশেষ কমিটি হয়েছে কোনো রকমের ভোটাভুটি ছাড়াই। পণ্যভিত্তিক বড় সংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি, বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ কিছু সংগঠনে এখন আর ভোট হচ্ছে না। এমনকি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমতি ফেডারেশনের কমিটিও হয়েছে নামমাত্র ভোটাভুটির মাধ্যমে। তবে রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের দখলে ওইসব সংগঠনকে রাখার কারণেই মূলত ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করা সম্ভব হয় না। ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা হতে পারলে নির্বাচনে মনোয়ন পাওয়া, রাজনৈতিক দলের পদ পাওয়া, এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিদেশে ভ্রমণ করার সুযোগ হয়। পাশাপাশি নিজ নিজ ব্যবসার ক্ষেত্রেও সুবিধা হয়। এসব কারণে ব্যবসায়ীদের একশ্রেণীর মধ্যে যে কোনোভাবে নেতা হওয়ার একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে।
একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি বিরাজ করে তখন সেখানে আর জবাবদিহিতার বিষয়টি থাকে না। আর তখনই সর্বত্র জোর যার দাপট তার নীতি অঘোষিতভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে চালু হয়ে যায়। দেশে এখন সেটাই বিরাজ করছে। ১৯৭০ সাল থেকে ৭২ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। আর কোন নেতা এরকম জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। এটা যেমন সত্য, তেমনিভাবে চিত্রের উল্টো দিকে তাঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ’৭৪ সালের শেষে দিকে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল এটাও সত্য। শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন ভোটের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু তিনিই আবার ভোটের অধিকার ভূলন্ঠিত করেছিলেন। ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের তিনটি নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সর্বশেষ ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৯৮৮ সালে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আ স ম আবদুর রবকে সঙ্গী করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার গদি নিশ্চিত করেছিল। ঐ নির্বাচনে প্রধান দলগুলো আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করেনি। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করেনি। সারাদেশে দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন পার করলেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। (এই সালেই তত্তা¡বধায়ক সরকারের অধীনে সবাইকে নিয়ে আবার নির্বাচন হয়) সর্বশেষ ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করেনি। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যেভাবে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে ঐ নির্বাচনকে প্রতিহত করতে পেরেছিল সেভাবে যদি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আন্দোলন সংগ্রাম করতে পারতো তাহলে হয়তো ৫ জানুয়ারির কংলকের দাগ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হতো না। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৮৬ সালে এরশাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্যই শেখ হাসিনা স্বৈরাচার এরশাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ এরশাদ ও তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে এ নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন। এরশাদের সাথে দেনা-পাওনার হিসাবটা সুদে আসলে মিলিয়ে নিতে এবার আওয়ামী লীগ সক্ষম হয়েছে। ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ওই সব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন এদেশে সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সুশাসনের অভাব দেখা দিয়েছে যা সংশোধন করতে না পারলে সামনে আরো বিপর্যয় ডেকে আনবে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে শুধু ভোট বিদায় নিয়েছে তা কিন্তু নয়! ব্যবসায়ী সংগঠনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে বিনা ভোটের কমিটিতে আওয়ামী লীগের পদধারীরা নেতা হচ্ছেন। যে হারে দুর্নীতির পাল্লা ভারি হচ্ছে সে তুলনায় দুর্নীতি প্রতিরোধের কার্যকরী উদ্যোগী ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এককথায় দেশে দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের জবাবদিহির অভাব। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০০৮ সালে উল্লেখ করেছিল এমপি, মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব দিবেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তা তারা বেমালুম ভুলে গেছেন। বিরোধী মতাবলম্বীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেভাবে দুদককে ব্যবহার করা হচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও যদি সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের বেলায় দেখানো হতো তাহলে দুর্নীতি অনেকটাই হ্রাস পেত। শুধু দুর্নীতি নয় সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা তখনই সম্ভব যখন জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা যায়। আর একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনই পারে সরকারের চূড়ান্ত জবাবদিহির বিষয়টি উন্মোচিত করতে। সরকারের ভেতরে যদি এই জবাবদিহিতা সৃষ্টি না করা যায় তাহলে দুর্নীতি ঠেকানো সম্ভব নয়। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও জনগণের ভোটাধিকার তথা আইনের শাসন, ব্যক্তির অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে সরকারের চূড়ান্ত জবাবদিহির জায়গা হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সরকারের একটা ভীতি থাকে। যখন এই ভয় থাকে তখন সরকার চেষ্টা করে অত্যাচার, অনাচারের মাত্রা কিছুটা কম করতে। কিন্তু এই ভয় যখন কোনো সরকারের মধ্য থেকে চলে যায় তখন ন্যূনতম জবাবদিহির জায়গাটুকু থাকে না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে দেশের নাগরিকদের মধ্যে ততই উদ্বেগ, উৎকন্ঠা বাড়ছে। সরকার ৫ই জানুয়ারির মতো একটি প্রহসনের ভোটের আয়োজন করে হয়তো নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে, ভূলুন্ঠিত করে পৃথিবীর কোন শাসকই ক্ষমতায় বেশী দিন টিকে থাকতে পারেনি। অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের কারণেই তো জার্মানির গণতন্ত্র ও অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা সরকার জনগণের ভাষা অনুধান করে উধাও হয়ে যাওয়া ভোটের অধিকার আবার জনগণের নিকট ফিরিয়ে দিবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/322773